প্রতিবেশী কাক মায়ের বাচ্চাদুটো স্বাবলম্বী হয়েছে, এখন সকাল হলেই মায়ের সাথে খাবারের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে, আবার কিছুক্ষণ ট্রেনিং শেষে ফিরে আসে। এদিকে পাশের বাসার দুষ্টু বাচ্চাগুলো বাশ দিয়ে ঠেলে ঠেলে কাকের বাসা ভেঙে নিয়েছে, তাদের অভিযোগ, কাক নাকি তাদের বাসা থেকে তার নিয়ে বাসা বানিয়েছে। ভাবলাম, বাচ্চারা বড় হয়েছে, এখন বুঝি বাসার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেছে, পাখির জীবনযাত্রা সম্পর্কে অত বেশি তো জানা নেই। কিন্তু কাক পরিবার ফিরে এসে বাসা খুজে না পেয়ে আবার বানাতে লেগেছে। চোখের সামনে বসে দেখছিলাম সুন্দর ঘর বানানোর দৃশ্য। সুবহানাল্লাহ! কোথার থেকে একবার খড়, একবার গাছের ডাল, একবার তার নিয়ে আসছে! এরপর ঠোট দিয়ে খুটিয়ে খুটিয়ে তা দিয়ে বাসা বানিয়ে ফেলছে, সুবহানাল্লাহ! অবাক লাগলো খুব, তার দিয়ে বাসা বানাতে হয়, কংক্রীটের বাড়ি বানানোর এই বুদ্ধি কোত্থেকে পেলো এরা? আর কোথায় কার বাড়িতে তার আছে, তা জানবেই বা কি করে!! কাক নিয়ে আরেকটু বিস্তারিত জানার আগ্রহে গুগলে একটু সার্চ দিলাম…
এত্ত কাছে বাস করে একটা প্রাণী, অথচ তার স্ট্যাটাস তো প্রাণিকুলে বেশ উপরে! ছোটবেলা থেকেই কাককে নোংরা প্রাণী, ধূর্ত প্রাণী এসব নামে জেনে আসায় এর সম্পর্কে পজিটিভ কোন আইডিয়াই ছিলোনা, অথচ এই কাকের বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কত কত রিসার্চ হয়েছে, দেখলে ভিমড়ি খেতে হয়। সবচেয়ে বুদ্ধিমান পাখি নাকি এই কাক! আচ্ছা, অবাক হচ্ছেন তো? অল্পকথায় কাক প্রজাতির কিছু বিশেষত্ব বলার চেষ্টা করি-
১। কাক এতটাই বুদ্ধিমান যে, মানুষের পরে শিম্পাঞ্জি ও গরিলার বুদ্ধিমত্তার প্রায় সমান বুদ্ধি ওদের। কাকের শরীরের আকারের তুলনায় ব্রেইনের আকার বেশ বড়। শিম্পাঞ্জির বুদ্ধিমত্তা ৬-৭ বছর বয়সের মানুষের বাচ্চার বুদ্ধিমত্তার সমান, তেমন কাকেরও। শিম্পাঞ্জির মতো কাক আটকে থাকা কোনো খাবার বের করে আনার জন্য হুকঅলা কাঠি ব্যবহার করে। শিম্পাঞ্জি সাধারণত উইপোকার টিবিতে কাঠি ঢুকিয়ে দিয়ে উইপোকা বের করে খায়। প্রাণিবিজ্ঞানীরা কাককে feathered apes বলে থাকেন। Mc Goan নামের একজন বিজ্ঞানী বলেছেন, কাক undergraduate দের চেয়ে smart।
ভিডিও দেখুনঃ https://youtu.be/ZOUyrtWeW4Q
২। কাকের সঙ্গে খারাপ কিছু ঘটলে পাঁচ বছর পর্যন্ত সেই ঘটনা তারা মনে রাখতে পারে। একটি কাক যে শুধু নিজের ভেতরেই রাগ পুষে রাখে তা নয়, নিজ দলের সবাইকেও সেই মানুষটার কথা জানিয়ে দেয়।কেউ যদি এদের একবার আক্রমণ বা বিরক্ত করে, এরা আগ্রাসী হয়ে তাকে আক্রমণ করতেও দ্বিধা করে না। এমনকি অন্যান্য কাক এক হয়েও আক্রমণকারীকে আঘাত করে থাকে।
৩।কাকের স্মৃতিশক্তি খুবই ভালো। নিজের লুকানো খাবার এরা নয় মাস পরেও খুঁজে বের করতে পারে। অন্য পাখি খাবার লুকিয়ে রাখার সময় তা কাক দেখলে প্রয়োজনে সেই লুকানো খাবার আনতে কখনো ভুল করে না।
৪।একটি কাক মারা গেলে অন্য কাকরা মিলে এর শেষকৃত্য করে। ঠিক মানুষের মতো। কাকদের জীবনের অদ্ভুত এই তথ্যটি গবেষণা করে বের করেছিলেন কাক গবেষক কেলি সুইফট। এরা মৃত কাকদের আশপাশে জড়ো হয় বিপদের আচ পেলে, কোনভাবেই সেখান থেকে তাদের সরানো যায়না। এমনকি পেলেট গান দিয়ে গুলি করেও না। কারণ কাকরা জানে বন্দুকের গুলি থেকে কত দূরে কখন থাকতে হবে। তাছাড়া তাদের কোন সাথী কাক মারা গেলে দলে দলে কাক সেখানে ছুটে যায় এবং মরা কাককে ঘিরে গোল হয়ে দাঁড়ায়। কোনো মানুষ বা অন্য প্রাণী দেখলে তাকে ক্ষুব্ধ হয়ে আক্রমণ করে। মৃত কাকটিকে কোনো কাক খায় না। বরং জানতে চায় কে তাকে মেরেছে? সেই মৃতদেহ ঘিরে জোরে জোরে কা . . . . কা . . . করে অনেক সময় ধরে ডাকে। সব শেষে, কাকগুলো চলে গেলেও জায়গাটার কথা মনে রাখে। ওই জায়গাতে অনেক খাবার থাকলেও আর কখনো কাকেরা ফিরে আসে না।
ভিডিও দেখুনঃ https://www.youtube.com/watch?v=KUNXWhmnOzk
৫।এদের বুদ্ধিমত্তার আরেকটি উদাহরণ দেই। ধরুন, বাদাম, আখরোট বা অন্য কোনো শক্ত খাবারের খোসা আমরা হাত দিয়েই খুলতে পারি। স্বাভাবিকভাবেই কাকের সেই ক্ষমতা নেই। এরা এই ক্ষেত্রে ব্যবহার করে ট্রাফিক সিগন্যালকে। সিগন্যাল মুখস্থ রেখে ওপর থেকে সঠিক সময়ে খাবারটি ফেলে দেয়, যেন গাড়িটি সেটিকে পিষে দিয়ে না চলে যায়। ভেবেছেন খাবারটি রাস্তায় পড়ে থাকলেই কাক এসে তুলে নেয়? মোটেও নয়! এই বিষয়ে এরা কোনো তড়িঘড়ি করে না। ট্রাফিক সিগন্যালে গাড়িগুলো যখন দাঁড়িয়ে যায়, তখনই ঠোঁটে করে খাবারটি তুলে নিয়ে ফেলে কাক। এমনভাবে গাছের ফলও পেড়ে খায় এর।
ভিডিও দেখুনঃ https://youtu.be/HdAlnMrB_Pg৬। আপনার যদি কখনও মনে হয়, কোন কাক আপনার দিকে তাকিয়ে আছে, আর পাশের কাকটির সাথে কথা বলছে। হ্যা, ধরে নিতে পারেন, সে আপনাকে নিয়েই কথা বলছে তার কাছে, যদি আপনি তার কোন ক্ষতি করে থাকেন। কাকদের নিজেদের মাঝে কথা বলার আলাদা ভাষা আছে, আলাদা টোন আছে। অন্য গোত্রের সাথে কথা বলারও ভাষা আছে। জরুরী কাজে ডাক দেয়ারও আলাদা টোন আছে।৭। তাদের বুদ্ধিমত্তার একটি অনন্য বিশেষত্ব হলো, এরা অনেক জটিল রহস্যের সমাধান করতে পারে। এরা তার বাকিয়ে হুক তৈরি করতে পারে, সম্ভবত এই ক্ষমতা প্রাণীজগতের মধ্যে মানুষের পর শুধু কাকেরই আছে। আর এই হুক দিয়ে জটিল ফাদ থেকেও খাবার টেনে বের করে খাওয়ার বুদ্ধি রাখে।ভিডিও দেখুনঃ https://youtu.be/cbSu2PXOTOc৮। লম্বা পানির কলসিতে পানি নাগাল না পাওয়ায় এর ভেতর পাথর ফেলে পানির উচ্চতা বাড়িয়ে খাওয়ার যে গল্প আমরা শুনেছি, এই গল্প কাকের রিসার্চে বাস্তব প্রমাণিত হয়েছে।ভিডিও দেখুনঃ https://youtu.be/l5rHHb52vAs৯। SAT টেস্টে Analogy সেকশনে যে টেস্টগুলো দেয়া হয়, তাতে হয়তো কাক আপনাকে হারাতে পারবেনা, কিন্তু এদের এনালোজি পাওয়ার অত্যন্ত প্রখর।একাধিক সম আকৃতির বস্তুর মধ্যে হালকা-ভারী আন্দাজ করতে পারে, বাইরে থেকেই নিরেট ও ফাপা বস্তুর পার্থক্য করতে পারে, পানির উচ্চতার তারতম্য আন্দাজ করতে পারে।ভিডিও দেখুনঃ https://youtu.be/ZerUbHmuY04১০। এদের সামাজিকতার সেন্সও বেশ উন্নত। নিজেদের ভেতর দলীয় আলোচনায় যেমন দক্ষ, তেমন মানব সমাজের আশেপাশে মানুষের সাথে তাল মিলিয়ে কিভাবে থাকতে হয়, সেই জ্ঞানেও পারদর্শী।আগ্রহীরা ছোট্ট ভিডিওক্লিপগুলো দেখে কিংবা ডকুমেন্টারি দেখে আন্দাজ করতে পারবেন, কি পরিমাণ বুদ্ধিমান একটা পাখি আমাদের আশেপাশেই উড়ে বেড়ায়, ছোটবেলা থেকে যাদের আমরা নেগেটিভভাবেই চিনে এসেছি। এতকিছু জানার পর একটা কথাই কেবল মুখ থেকে বের হয়ে আসবে- সুবহানাল্লাহ!! এই ছোট্ট পাখিটিকে এত গভীর জ্ঞান তো কেবল আল্লাহই দিয়েছেন!-أَفَمَن يَخْلُقُ كَمَن لاَّ يَخْلُقُ أَفَلا تَذَكَّرُونَ-وَإِن تَعُدُّواْ نِعْمَةَ اللّهِ لاَ تُحْصُوهَا إِنَّ اللّهَ لَغَفُورٌ رَّحِيمٌ
“যিনি সৃষ্টি করেন, তিনি কি তাদের সমতুল্য হতে পারেন যারা সৃষ্টি করতে পারে না? তবুও কি তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করবে না? যদি তোমরা আল্লাহর নেয়ামত গণনা কর, তবে তা গুণে শেষ করতে পারবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, বড়ই দয়ালু” (সূরা নাহলঃ আয়াত ১৭,১৮)