মিসিং ইউ, আব্বু

– আব্বু, কেমন আছেন?
– এইতো আছি, বাবা। ফাতিমাকে নিয়ে তোমাদের খুব কষ্ট হচ্ছে, না? আমি কয়েকদিনের মধ্যেই চলে আসছি, ইনশাআল্লাহ।
– হ্যা, ফাতিমা তো নানাকে খুজছে সারাদিন। আচ্ছা ক’দিন বেড়িয়েই আসেন।

আমাদের বাবামায়েরা আমাদের জন্য পরিশ্রম করেন, তিল তিল কষ্ট করে আমাদের বড় করে বিয়েশাদি দেন, অনেক ছেলেমেয়ে দূরে চলে যায়, আবার অনেক ছেলেমেয়ে বাবামায়ের সাথেই থাকে, তখন বাবামায়েরা নানা-দাদা হয়ে গিয়ে আবার আমাদের সন্তানদের জন্য কষ্ট করা শুরু করেন। এই কষ্টের আর শেষ নেই। তারা কী চান? কিছুই না, শুধু একটু স্বীকৃতি। এটা যে তারা চান তা হয়তো তারা নিজেরাও জানেন না, কিন্তু এটাই সাইকোলজি।

বাচ্চারা যখন বড় হয়, নিজের পায়ে দাড়াতে শেখে, তখন বাবামায়ের চেয়ে খুশি আর কেউ হননা। কিন্তু তারা মনের অজান্তে হলেও এটুকু চান, যে পায়ের উপর দাঁড়িয়ে আমরা দাড়াতে শিখেছি, তাদের সেই স্বীকৃতিটুকু দিই। সন্তানেরা তাদের পাশে না থাকতে পারলেও ‘আমার সন্তান আমাকে দূরে থেকেও মিস করে’ এই অনুভূতিটুকুও তাদের স্বস্তি দেয়। কিন্তু ব্যস্ততার জীবন, আমরা সেটুকুও ভুলে যাই।

অন্যদের কথা কী বলবো? আমি নিজেই অনেকটা মুখচোরা স্বভাবের। অনেক কথাই মন থেকে অনুভব করলেও বলতে গিয়ে বলা হয়ে ওঠেনা: কী ভাববে আবার! কেম্নে এটা বলি!
কিন্তু সত্য হচ্ছে, অনুভূতির প্রকাশটাও একটা আর্ট, যারা পারেন তাদের জন্য খুব ভালো, যারা পারেন না তাদের জন্য একটু কঠিন বটে। তবে চেষ্টায় সম্ভব….

হয়তো আমরা এখন স্বনির্ভর হয়ে গেছি, বাবামাকে ছাড়াই বেশ ভালো থাকতে পারি। কিন্তু ঐ মানুষদুটোর কাছে তো আমরা এখনও সন্তান, আমাদের ফাকা জায়গাগুলো সন্তান দিয়ে পূর্ণ হয়ে গেলেও তাদের সন্তানের জায়গাটুকু তো ফাকাই রয়ে গেছে। আগের মত তাদের নির্ভরতা আমাদের আর নেই, এটা তারা জানেন। আমাদের একটুখানি দরদমাখা অনুভূতিই তাদেরকে সন্তুষ্ট করে, বৃদ্ধ বয়সে তারা বেচে থাকার উদ্দেশ্য খুজে পান, সারাজীবনের সব কষ্ট বৃথা গেলো, এই গ্লানিটুকু থেকে মুক্তি পান।

– মা, আজ রান্না করতে গিয়ে তোমার কথা মনে পড়লো, তুমি কত্ত কষ্ট করে আমাদের রান্না করে খাওয়াতে।

– বাবা, আজ তোমার কথা খুব মনে পড়ছে, তুমি কত কষ্ট করে আমার বাবুটাকে কোলে নিতে, এখন আর কাউকে পাইনা।

সামান্য একটু প্রকাশ, কিন্তু ফলাফলটা অনেক বড়: বাবামা এটুকুতেই যে কত খুশি হন, মেপে দেখানো যাবেনা। আর বাবা-মায়ের সন্তুষ্টিতেই যে আল্লাহর সন্তুষ্টি, এই বিষয়টা আমাদের কারো অজানা থাকার কথা নয়। কিন্তু আমরা যারা এটুকুও পারিনা, তারা অনেকসময় নিজেকে প্রবোধ দিই: ‘আমিতো বলতে ওভাবে পারিনা, তাতে কী? মনে মনে তো ঠিকই ভালোবাসি।’ এটা একটা ধোকা। কেন জানেন?

আবার একটা চিত্র দেখাই। মনে করুন, আজকে আপনার কোলে যে বাচ্চাটা, ও অনেক বড় হয়ে গেছে, তার স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে বাইরে কোথাও সেটেল হয়ে গেছে৷ আপনারা স্বামী-স্ত্রী দুজন আবার আগের মত একা বাসায়। আপনাদের কি মনে চাইবেনা? আপনাদের সন্তান মাঝে মাঝে আপনাদের মিস করুক, একটু ফোন দিয়ে কুশল জিজ্ঞেস করুক, আপনারা কেমন আছেন জানতে চাক….

আপনি যখন দূরে কোথাও ট্রাভেল করেন, আপনার বাবা-মা বার বার দুয়া পড়ে ফু দেন, বার বার ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করেন: বাবা, রাস্তায় কোন সমস্যা হয়নি তো? আপনার বাবামা যখন দূরে কোথাও ট্রাভেল করেন, ঠিক তাদেরও ইচ্ছে হয়, আমার সন্তানও আমার খোজ নিক….

আমরা আসলে অনেক বেশি কর্মব্যস্ত, এত্ত এত্ত কাজের ভিড়ে সবকিছু হয়তো মনে রাখা সম্ভব হয় না। ঠিক আছে, ফোন না দিতে পারেন, টেক্সট করে বলুন, সেটা তো পারেন। যদি তাও না পারেন? আপনার কোন একটা কাজ দিয়ে কিংবা উনাদের পছন্দের কোন একটা জিনিস গিফট করে কৃতজ্ঞতাটুকু প্রকাশ করুন। খুব কি কঠিন?

ছেলের বিয়ের পর মা-বউ নিয়ে যে কনফ্লিক্টগুলো তৈরি হয়, তার মধ্যে এটা একটা বড় কারণ। বিয়ের পর ছেলে তার স্ত্রী নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তারপরেও উচিৎ দিনের মধ্যে মায়ের জন্য কিছুটা হলেও আলাদা সময় রাখা, হোক তা বিশ মিনিট। কিছুটা সময় একান্তে মায়ের পাশে গিয়ে বসা, নিজেদের সুখ-দুঃখের কথাগুলো ভাগাভাগি করা, স্ত্রীর গুণগুলো বলার আগে মায়ের গুণগুলো আরেকটু জোর দিয়ে বলা, স্ত্রীর রান্না ভালো হলেও মায়ের সামনে মায়ের রান্নার গুণগান বেশি করা, নিজের আচরন দিয়ে এটুকু বোঝাতে চেষ্টা করা: মা, আমি বিয়ে করেছি, স্ত্রীর হক্ব পালন করছি, কিন্তু তোমার স্থানটুকুও আমার কাছে ‘সংরক্ষিত’ই আছে।

এই ট্যাক্টিকটা খাটাতে কিন্তু স্ত্রীকে অসন্তুষ্ট করা, স্ত্রীর অধিকার নষ্ট করার দরকার পড়েনা। শুধু আপনার একটু সদিচ্ছা, একটু চিন্তাশীল প্রকাশভঙ্গীই যথেষ্ট। স্ত্রীর সামনে মায়ের প্রশংসা করলে যদি কষ্ট পায়, তাহলে স্ত্রীর পেছনে করুন, আপনি তো গীবত করছেন না। এইটুকু বুদ্ধি খাটাতে যারা ব্যর্থ হন, তাদের বাবামায়েরাই মনে করে বসে, ‘বউটা আমার ছেলেকে বশ করে ফেলেছে’, ‘আমার ছেলেটা বউয়ের হয়ে গেছে, আমার আর নেই’, পরবর্তীতে সেই প্রভাবগুলো গিয়ে পড়ে ছেলেবউ এর উপর। একজন পুরুষের জন্য এই ক্রিটিক্যাল বিষয়টা হ্যান্ডেল করা খুব কঠিন, তারপরও সাইকোলজি বুঝে ট্রিট করলে একটু সহজ হয় আরকি…..

অনেকে হয়তো বলবেন, আমি এই লেখাগুলো কেবল একপক্ষ থেকেই কেন লিখছি? উত্তরটা হচ্ছে, বাবা-মা হিসেবে সন্তানের প্রতি আচরন কেমন হওয়া উচিৎ, আমাদের বাবা-মায়েদের করা কোন কোন ভুলগুলো আমাদের আর রিপিট করা উচিৎ না, সেসব নিয়ে যে শাস্ত্রে আলোচিত হয়, তার নামই তো ‘প্যারেন্টিং’। প্যারেন্টিং নিয়ে তো অনেক বই বাজারে আছে, আমরা পড়ছি, আপনারাও পড়ুন, সময় সুযোগ হলে ও নিয়েও লিখবো ইনশাআল্লাহ। কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে সন্তানের প্রতি বাবামায়ের অনুভূতি নিয়ে কোন লেখা নেই, হয়তো ৫০, ৬০+ বয়সে গিয়ে উনাদের আর কলম ধরার ইচ্ছে হয়না সেজন্যেই। তাদের পক্ষ থেকেই কিছু লেখার প্রয়াস আরকি। সবকিছুর মোদ্দাকথা, সন্তান এবং প্যারেন্ট হিসেবে আমাদের দায়িত্ব এটুকুই:

“Be a conscious Parent to your growing Child, be a conscious Child to your grown-up Parents.” ♥

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *