আমরা আলোচনা করছিলাম বিখ্যাত মানুষদের কাজের প্রতি ফোকাস ও ডেডিকেশান নিয়ে। এ বিষয়ে আমার আমার খুব পছন্দের আরেকটি দর্শন হচ্ছে Carl Jung’s Bimodal Philosophy of Deep Work. কার্ল জাং একজন সুইস সাইকোলজিস্ট। পারিবারিক ও দৈনন্দিন কাজের ব্যস্ততায় উনি গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো করার সময় পাচ্ছিলেন না। তো করলেন কি, উনার নিজ শহর, সুইজারল্যান্ডের বলিজেন এর বাইরে নিরব একটি জায়গায় পাথর দিয়ে একটা বাসা বানিয়ে ফেলেন, শুধু তার গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো মনোযোগ দিয়ে করার জন্য। তিনি মাসের কয়েক সপ্তাহ ঐ স্টোনহাউসে গিয়ে একান্ত নিরবতায় কাটাতেন, এরপর আবার ব্যস্ততার জীবনে ফিরে আসতেন। উনার এই চিন্তাকে নাম দেয়া হয়েছে ‘Bimodal Theory’, যেটা হচ্ছে কিছুটা সময় একদম নিরবতায় কাটিয়ে ডীপ ওয়ার্ক করা, এরপর বাকি সময়টা ব্যস্ত জীবনে কাটানো।
তো জীবনের লক্ষ্যে কিংবা কোন একটি কাজে ‘ফোকাসড’ থাকার উপায় কী? এ প্রশ্নের উত্তরে নানা মুনির নানা মত প্রচলিত আছে। আমার পছন্দের কিছু ‘মুনির মত’ আলোচনা করবো, ইনশাআল্লাহ।
এ বিষয়ে জ্যাক ক্যানফিল্ড ও মার্ক ভিক্টরের খুব সাড়া জাগানো একটি বই আছে “The Power of Focus”। এখানে বলা হচ্ছে, কোন একটি কাজে ফোকাসড থাকতে হলে আপনাকে হতে হবে – B- ALERT।
B = Blueprint : আগামীকাল আপনাকে যে কাজটি করতে হবে, তা কখন কীভাবে, কত সময়ে করবেন, তা আজ রাতেই লিখে রাখতে হবে। এটিই আপনার ‘ব্লু-প্রিন্ট’।
A = Action : ব্লু প্রিন্ট অনুযায়ী আপনার করণীয় কাজ শুরু করুন।
L = Learn : যে কাজটি আপনি করতে চাচ্ছেন, তা শুধু করলেই হবেনা। সে বিষয়ে আপনার জানার পরিধি আরও বাড়াতে হবে। বই পড়ে হোক, গুগল করে হোক, ইউটিউবে ছোট কোন ক্লিপ দেখে হলেও জানতে থাকুন, শিখতে থাকুন।
E = Exercise : শুধু কাজ করলেই নয়, শরীর ফিট না থাকলে কাজেও মনোযোগ থাকবেনা৷ তাই নিয়মিত কিছু এক্সারসাইজ করতে হবে, যা আপবাকে নতুন ভাবে শক্তি দেবে।
R = Relax : একটানা শুধু কাজই নয়, নির্দিষ্ট সময় কাজ করার পর বিরতি নিন। ঘণ্টায় ৫ মিনিট, দুপুরে ‘ক্বাইলুলাহ’, রাতের ঘুম… এসব কিছু আপনার স্ট্রেস কমাতে সাহায্য করে, রিবুট করে।
T = Think : দিনের শেষে প্রতিদিন নিজ কাজের হিসাব মেলাতে হবে। কোথায় কতটুকু ঘাটতি আছে, তা হিসেব করে নতুন দিনের ব্লু-প্রিন্ট লিখে রাখতে হবে।
ফোকাসড থাকার আরেকটি কার্যকরী উপায় হচ্ছে, আপনার দৈনন্দিন জীবনের কাজগুলোকে প্রায়োরিটাইজড করতে হবে। তার জন্য রয়েছে “4-D Solution“, এটি টাইম ম্যানেজমেন্টেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ থিওরি। কোন একটি কাজ সামনে আসলে প্রথমেই আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে এটি কোন ক্যাটাগরির কাজ (আর্জেন্ট- ইম্পর্ট্যান্ট ম্যাট্রিক্স দ্রষ্টব্য)। এবং তারপর-

1. Do it : জরুরী হলে এক্ষণই করে ফেলুন।
2. Defer it : অন্য জরুরী না হলে অন্য সময় নির্ধারণ করুন।
3. Delegate it : কাউকে দিয়ে করানোর মত হলে হ্যান্ডওভার করে দিন।
4. Dump / Delete it : অপ্রয়োজনীয় হলে কাজের লিস্ট থেকেই এটি বাদ দিয়ে দিন।
কাজে মনোযোগ বাড়ানোর আরও কিছু উপায় আছে, সাদমান সাদিক এর ইউটিউব চ্যানেকে এমন কিছু পয়েন্ট তুলে ধরা হয়েছে, এগুলো বেশ কার্যকরী।
১. Purpose Set : আপনাকে যদি বলা হয়, অমুক কাজটি করতে পারলে বিনিময়ে আপনাকে এক লক্ষ টাকা দেয়া হবে, তাহলে আপনি কতটা গুরুত্ব নিয়ে সেই কাজটি করবেন? আপনার জীবনের জন্য যে কাজটি জরুরী, তার বিনিময়ে এই টাকা কেউ না দিলেও কাজটির মূল্য আসলে ততখানিই বেশি, এমনটি ভেবে উদ্দেশ্য ফিক্স করুন।
২. Break : কাজের ফাকে ফাকে বিরতি নিন। এ ব্যাপারে একটি সুন্দর উপায় হচ্ছে ” Chunk & Chew” মেথড। ১০ মিনিট একটা কাজ করার পর ২ মিনিট তা নিয়ে চিন্তা করুন, রিফ্লেক্ট করুন। ১০ মিনিট chunk, আর ২ মিনিট chew. এর আগে টাইম ম্যানেজমেন্ট সিরিজগুলোতে আমি এমন আরও বেশকিছু মেথড উল্লেখ করেছি, যেমন: Pomodoro Technique। তবে আগেও বলেছিলাম, ব্রেক নিতে চাইলে তখন অবশ্যই সোশ্যাল মিডিয়া ব্রাউজ করা যাবেনা, কারণ তাতে ব্রেইন রেস্ট পায়না। তাই জোরে জোরে শ্বাস নেয়া, প্রকৃতি দেখা, একটু হেটে আসা, পানি খাওয়া এগুলো করতে পারেন।
৩. Environment : কোন কাজ মনোযোগ দিয়ে করার জন্য খুব দরকারি হচ্ছে, উপযুক্ত পরিবেশ। সেই পরিবেশ বেছে নিন।
৪. Exercise : একটু আগেই বললাম।
৫. Food Habit: আপনাকে একটি স্বাস্থ্যকর ফুড হ্যাবিট চর্চা করতে হবে। যেমন: প্রচুর পানি পান, সুষম খাদ্য খাওয়া, ফাস্টফুড কম খাওয়া ইত্যাদি৷ কারণ শরীর একবার ভেঙে গেলে আর উঠে দাড়ানো কঠিন হয়, আর শরীর ভালো না থাকলে কোন কাজেও মন বসবে না।
৬. Habit : নিয়মিত কাজটি করার অভ্যাস করতে হবে। আর একটি নতুন চর্চাকে অভ্যাসে আনতে কমপক্ষে ২১ দিন লাগে। অন্তত ২১ দিন একটানা কাজটি করুন। এ বিষয়ে আমার ‘অভ্যাস-কথন’ নোটে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।
৭. Cutting Distraction: আশেপাশে মনোযোগ ডিসট্র্যাক্ট করবে, এমন সবকিছু আগেই সরিয়ে নিতে হবে। যেমন, মোবাইল অফ করে অথবা সাইলেন্ট করে উল্টিয়ে হাতের নাগাল থেকে দূরে রেখে দিন কিছুটা সময়ের জন্য।
৮. Fixing Deadline : কোন একটি কাজে হাত দেবার আগেই ‘ডেডলাইন’ ফিক্স করে নিন, কতদিনের মধ্যে আপনাকে কাজটি শেষ করতে হবে। আর সেই টার্গেট ফিক্স রেখেই প্রতিদিন কাজ করে যান।
৯. Follow Up : কাজের গতিবিধি নিয়ে নিয়মিত পর্যালোচনা করুন। কতটুক এগোলো, যেমনটা চেয়েছিলেন তেমন হচ্ছে কিনা, কত সময় বাকি আছে ইত্যাদি নিয়মিত মনিটর করুন।
এইভাবে একটু একটু করে অভ্যাস করতে থাকুন, দেখবেন একসময় আপনি নিজেই অটো-ফোকাস মোডে চলে এসেছেন, তখন আর ফোকাস আনতে এত কসরত করতে হচ্ছেনা। আর একটি মজার তথ্য দিয়ে শেষ করি-
আচ্ছা, বলুন তো, একটানা দীর্ঘক্ষণ ফোকাস রাখার জন্য আমাদের মুসলমানদের জন্য সবচেয়ে সহজ অনুশীলন কোনটি?
– ‘সালাত’। আমরা প্রতিদিন কমপক্ষে ৫ বার সালাতে দাড়াই, আর সালাত শুধু শারীরিক একটি ইবাদাতই নয়, তারচেয়েও বেশি মানসিক ও আধ্যাত্মিক। সালাত হচ্ছে মুমিনের মি’রাজ, তাই সবটুকু ধ্যান-খেয়ালের সাথে খুশু ও খুযু নিয়ে আমাদেরকে সালাত পড়তে হয়। ‘আল্লাহু আকবার’ তথা আল্লাহ অন্য সবকিছুর চেয়ে বড়, এই ঘোষণা দিয়ে অন্য সবকিছু থেকে ফারেগ হয়েই আমরা সালাতে দাড়াই। রাসূলুল্লাহ সা. সালাতে দাড়িয়ে পা ফুলে যেতো তাও কষ্ট অনুভব করতেন না। সাহাবায়ে আজমা’ইনরা এতটা ফোকাসড হয়ে সালাত পড়তেন যে সালাতের মাঝে বাড়িতে আগুন ধরে গেলে কিংবা নিজের শরীরে তীর বিধে গেলেও তা অনুভব করতেন না, সুবহানাল্লাহ!
এই একটি ইবাদাতে ফোকাস করতে পারলেই তো আমাদের জন্য সমস্ত কাজে ফোকাস করার অনুশীলন হয়ে যায়, তাই নয়কি? ফাসুবহানল্লাহি ওয়া বিহামদিহি!