অভ্যাস-কথন

অভ্যাস পরিবর্তন করা আমাদের সময়ের একটা বড় চ্যালঞ্জ, শুধুমাত্র অভ্যাসের জন্যই আমাদের অনেকের দিনের গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলো নষ্ট হয়ে চলছে, অনেক খারাপ কিংবা হারাম অভ্যাসের জালে আটকে পড়ে চাইলেও বের হতে পারছিনা, নতুন একটা ভালো অভ্যাস শুরু করবো, পারছিনা….

একটা অভ্যাস কিভাবে গড়ে ওঠে? চার্লস ডুহিগ তার “The Power of Habit” বইটিতে সুন্দর একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন। অভ্যাস তৈরির একটা ‘loop’ আছে, যেটাকে বলে Habit Loop (চিত্র- ১ দ্রষ্টব্য)। এটা কীরকম?

Cue(নিয়ামক) ➙ Routine(অভ্যাসগত কাজ) ➙ Reward(ফলাফল/পুরস্কার)

একটা উদাহরণ দিই:
মনে করুন, আমি একটা বই পড়ছি, বইয়ের পাশেই মোবাইল, পড়তে পড়তে হঠাৎ মোবাইলে আলো জ্বলে উঠলো কিংবা নোটিফিকেশন সাউন্ড, আমি সাথে সাথে মোবাইলটা হাতে তুলে নিলাম, এরপর নোটিফিকেশনে ক্লিক করে একটা নতুন কমেন্ট পেলাম, কমেন্টের উত্তর দিলাম, এরপর মনে একটু প্রশান্তি- যাক, একটা ভালো কিছু করলাম।

এখানে নোটিফিকেশন লাইট/সাউন্ডটা হচ্ছে Cue/Trigger, যার কারণে আমি মোবাইল হাতে নিলাম। এরপর ফেইসবুকে ঢোকার কাজটা Routine। আর কমেন্ট করার পর নিজের মনে যে তৃপ্তির অনুভূতি হলো, এটাই Reward।

এভাবে একটা চক্রের আকারে একই কাজ বার বার করতে থাকলে একসময় ওটা Habit/অভ্যাসে পরিণত হয়। গবেষণা বলছে, একটা অভ্যাস তৈরি হতে কিংবা বদলাতে মোটামুটি ৬৬ দিন লাগে।

 কীভাবে খারাপ অভ্যাস ত্যাগ করবো?

সম্ভব হলে নিয়ামক(Cue) টাই দূরে সরিয়ে রাখুন, বাকি সার্কেলটুকু এমনিই বন্ধ হয়ে যাবে।

যেমন:
 পড়তে বসার আগে মোবাইলটা সাইলেন্ট/অফ করে বসুন কিংবা মোবাইলটা হাত থেকে এতখানি দূরত্বে উপুড় করে রাখুন, যাতে নোটিফিকেশন সাউন্ড কিংবা আলো না আসে, চাইলেই হাত বাড়িয়ে নেয়া না যায়।

 অবসর সময়ে গান শুনতে ইচ্ছে করে, অবসর সময়টুকুকে আগেই অন্য একটা কাজে ইনভলভড করে রাখুন। কিংবা পিসিতে ঢুকলেই মিউজিক ফোল্ডারে ঢুকতে ইচ্ছা করে, ফোল্ডারটা হাইড করে রাখুন। সম্ভব হলে ডিলিট করে ফেলুন।

উহু, এমনটা আমি পারছিনা৷ অভ্যাসটা পুরো ছেড়ে দেয়া আমার জন্য কঠিন। তাহলে?

হ্যা, সব অভ্যাস আসলেও একেবারে মুছে ফেলা যায়না, কিংবা এটা খুব কঠিন কাজ। বরং অভ্যাসটাকে বদলানো তুলনামূলক সহজ। একটা খারাপ অভ্যাসকে ভালো অভ্যাস দিয়ে বদলে ফেলা সম্ভব। এটা কীভাবে?

 অভ্যাস পরিবর্তন:

নিয়ামক ও ফলাফল ঠিক রেখে মাঝের অভ্যাসটা বদলে ফেলুন।

নিয়ামক ➙ পুরাতন অভ্যাস ➙ ফলাফল

নিয়ামক ➙ নতুন অভ্যাস ➙ ফলাফল

দুটো উদাহরণ দিই:

১. কাজ করতে একঘেয়ে/টায়ার্ড লাগছে ➙ আপনি একটা সিগারেট মুখে নিলেন ➙ আহ! সতেজ অনুভূতি

মাঝখানের কাজটা হারাম থেকে হালাল কিছু একটা দিয়ে রিপ্লেস করুন:

টায়ার্ড ➙ এক মগ কফি ➙ সতেজ অনুভূতি।

২. মনটা উদাস উদাস উদাস লাগছে ➙ একটু গান(মিউজিক) শুনি ➙ আহ! শান্তি

আবারও মাঝের হারাম কাজটা হালাল দিয়ে বদলে দিই:

উদাস উদাস অনুভূতি ➙ সুন্দর একটা কুরআন রিসাইটেশন ➙ আহ! শান্তি(+ হালালের প্রশান্তি)।

 নতুন একটা অভ্যাস করতে চাই। কীভাবে করবো?

নিজেকে নিজেই অনেক বেশি মোটিভেশান দিয়ে, নিজেকে রিওয়ার্ডের লোভ দিয়ে হলেও কাজটা শুরু করে দিন। শুরু করাটাই বড় কথা, এরপর কয়েকদিন নিজের সাথে যুদ্ধ করে সেটা চালিয়ে যান। একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর সেটা করতে আর কষ্ট হবেনা, অভ্যাসেই পরিণত হয়ে যাবে।
যেমন: ফজরের সালাতের পর খুব ঘুম পায়, জেগে থাকতেই পারিনা। অথচ এই সময়টিতেই অনেক বেশি বারাকাহ, এইসময় রিযক্ব বণ্টন হয়। কী করি?
ফজরের সালাতের পর বিছানায় না গিয়ে আগেই চুলায় চা/কফির পানি বসিয়ে দিন, ঘুম ঘুম ভাব আসার আগেই চা/কফি খেয়ে নিন। কিংবা একটা কুরআন তিলাওয়াত শুনুন, একটা মিউজিক ছাড়া নাশীদ শুনুন, একটু খোলা বাতাসে হেটে আসুন। আপনাকে কোন সাওয়াবের কাজ করতে হবেনা, মুবাহ কোন কাজ করে হলেও ঐ সময়টা জাস্ট জেগে থাকার চেষ্টা করুন। একদিন, দুইদিন, তিনদিন,…. এরপর আস্তে আস্তে সহজ হবে। নিজেকে নিজেই রিওয়ার্ড দিতে পারেন। যেমন: এভাবে চিন্তা করুন, আমি আজ ফজরের পর জেগে থাকতে পারলে দুপুরে একটা আইসক্রিম খাবো। রিওয়ার্ডিং সিস্টেমটাও মোটিভেশানের জন্য ভালো সহায়ক।
কাজটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেলে এরপর ঐ সময়টা গুরুত্বপূর্ণ কোন কাজের জন্য ফিক্সড করে নিন। কঠিন কিন্তু সম্ভব।

বুঝলাম, তো অভ্যাসটা ধরে রাখবো কীভাবে?

 কয়েকটা টিপস বলে দিই:

১. আপনার দৈনন্দিন জীবনে কী কী হারাম/অপ্রয়োজনীয় অভ্যাস আছে, চিহ্নিত করুন। সেসব অভ্যাসের পেছনে নিয়ামক ও ফলাফল আছে খুজে বের করুন। এবার নিয়ামক ও ফলাফল ঠিক রেখে খারাপ অভ্যাসটাকে ভালো অভ্যাস দিয়ে রিপ্লেস করুন। কিংবা নতুন কোন ভালো অভ্যাসটা গড়তে চান, খুজে বের করুন। নিজেকে নিজে রিওয়ার্ড দেয়ার চেষ্টা করুন।

২. নতুন অভ্যাসটা চালিয়ে যান, ৬৬ দিন বেশি মনে হলে ২০ দিন, তাও না পারলে ১০ দিন একটানা করতে থাকুন। নফসের সাথে যুদ্ধ করে হলেও করতে থাকুন, একবার ভুল হলে আবার করুন, আবার হলে আবার করুন, হাল ছেড়ে দেওয়া যাবেনা। চালিয়ে যান।

২. দু’আ, দু’আ ও দু’আ:
অন্তর পরিবর্তনের মালিক আল্লাহ রব্বুল ‘আলামীন। দু’আ করতে থাকুন, আপনি এক বিঘত অগ্রসর হলে তিনি আপনার দিনে তিন বিঘত অগ্রসর হবেন, আপনি হেটে এগোলে তিনি দৌড়ে এগোবেন, এই প্রতিশ্রুতি তিনিই দিয়েছেন। দু’আ দিয়ে সব আদায় করে নেয়া যায়, দু’আ করতে থাকুন। দু’আ কবুলের বিশেষ বিশেষ সময় জেনে নিয়ে সেই সময়গুলোতে দু’আ করুন।(যেমন: বৃষ্টির সময়, অসুস্থ অবস্থায়, সফরের সময়, রোগীর সামনে, শুক্রবারে আযান ও ইকামাতের মধ্যবর্তী সময়, শুক্রবার আসরের সময়,…..)

দু’আ করুন নবীর শিখিয়ে দেয়া পন্থায়:

يَا مُقَلِّبَ الْقُلُوبِ ثَبِّتْ قَلْبِي عَلَى دِينِكَ.

“হে অন্তরসমূহের পরিবর্তনকারী, আমার অন্তরকে আপনার দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত করে দিন।”

اللَّهُمَّ مُصَرِّفَ الْقُلُوبِ صَرِّفْ قُلُوبَنَا عَلَى طَاعَتِكَ.
“হে অন্তরসমূহের পরিবর্তনকারী, আমাদের অন্তরসমূহকে আপনার আনুগত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত করে দিন।”

৩. বিশ্বাস রাখুন, ‘পরিবর্তন সম্ভব’, অবশ্যই ইনশাআল্লাহ সম্ভব। অমুক অমুক তমুক যদি পেরেছে, আমি কেন পারবোনা? দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি ছাড়া কক্ষণো কোন অভ্যাস পরিবর্তন করা যায়না। ইচ্ছাশক্তিকে দৃঢ় করুন। আপনাকে যদি কাজটির বিনিময়ে এক কোটি টাকা দেয়া হতো, আপনি কি পারতেন না? অবশ্যই পারতেন। তাহলে এবারও পারবেন। আর আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন তো কোটি টাকার চেয়েও বেশি মূল্যবান।

৪. সঙ্গ পরিবর্তন করুন, উত্তম সঙ্গী খুজুন, একই রকম একটা গ্রুপ তৈরি করে একসাথে কাজ করুন। একজন একটা অভ্যাস পরিবর্তন করা যত কঠিন মনে হয়, পাশে এমন আর দশটা মানুষকে একই কাজ করতে দেখলে তুলনামূলক সহজ লাগে। তাই খারাপ অভ্যাসে আসক্ত এমন সার্কেল চেইঞ্জ করে ভালো অভ্যাসে অভ্যস্ত এমন মানুষদের আশেপাশে থাকুন। যেমন: আপনার বই পড়তে ভালো লাগেনা, পড়ুয়াদের আশেপাশে থাকুন। আপনি ফজরের সালাতে উঠতে পারেন না, ফজরের সালাত আদায়কারীদের সাথে থাকুন, তাদেরকে সালাতের সময় ডেকে দিতে বলুন। আবার একই রকম অভ্যাস থেকে উত্তোরণের জন্য চেষ্টা চালাচ্ছেন, এমন কয়েকজন বন্ধু পেলে আপনারা একসাথে দলীয়ভাবে চেষ্টা করুন, তাহলে একজন আরেকজনের কাছ থেকে মোটিভেশান পাবেন, সাহসটা ধরে রাখতে পারবেন, ইনশাআল্লাহ।

এইতো মোটামুটি অভ্যাসের টুকিটাকি। শুরু হোক তবে পরিবর্তনের পথে চলা….

(আপনি যদি একটি অভ্যাসও সফলভাবে পরিবর্তন করতে পারেন, তাহলে লেখাটি অন্য কাউকে পড়তে দিন, আপনার সফলতার গল্পটি আমাদের সাথেও শেয়ার করুন।)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *