মির্জা ইয়াওয়ার বেগ

কিছু লোক আমাকে “খুব বড় ‘আলিম” ভাবতে পছন্দ করে। আমি মোটেও তেমনটি নই। আমি কোনো ছোট ‘আলিমও নই। আসলে আমি মোটেও কোনো ‘আলিম বা বিশেষজ্ঞ ধরনের কিছু নই। আমি সাধারণ একজন মানুষ—জীবনের মানেটা বোঝার চেষ্টা করছি। যা শিখি সেটা জানতে যারা আগ্রহী তাদের সাথে শেয়ার করি।

ইসলাম আমার জন্য এক অনুপ্রেরণা। জেনেবুঝেই আমি ইসলামকে বেছে নিয়েছি। বহু বছরের পড়াশোনা ও নানা প্রশ্নের মাধ্যমে যাচাই বাছাই করেই আমি একে বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ইসলামকে আমি গ্রহণ করেছি পরিপূর্ণভাবে এবং সর্বাত্মকরূপে। আল্লাহর কাছে চাই সারাটা জীবন তিনি যেন এর উপর আমাকে অবিচল রাখেন।

ইসলাম নিয়ে আমার পড়াশোনা শুরু হয় সায়্যিদ ক়ুতুবের করা আল-ক়ুর’আনের সর্বশেষ জুয (পারা)-এর অনুবাদ ও তাফসীর পড়ার মধ্য দিয়ে। আরও পড়েছি মার্টিন লিংস রচিত রসূলুল্লাহ সা.-এর জীবনীর উপর একটি বই। এ দুটো বই-ই জীবন ব্যবস্থা হিসেবে ইসলামকে বেছে নেওয়ার পথে আমার জন্য দরজা খুলে দিয়েছে। আল্লাহর কাছে দু‘আ করি তিনি যেন লেখকদ্বয়কে অনুগ্রহ করেন।

এরপর আমি পড়াশোনা করেছি শাইখ উইস্‌সাম আব্‌দুল-বাকির অধীনে। আর তারপর থেকে এমন এক অভিযাত্রায় পথ চলেছি যতদিন বেঁচে আছি ততদিন এই পথ শেষ হওয়ার নয়। এই অভিযাত্রা চূড়ান্ত গন্তব্যের পানে যাত্রা। এই অভিযাত্রা নিজেকে আবিষ্কার করার যাত্রা।

১৯ বছর বয়সে গায়ানা বিমানবন্দরে যখন নামি আমার সব লাগেজ তখন লাপাত্তা। দেশের বাইরে এটাই ছিল আমার প্রথম সফর আর তাতেই খুইয়ে বসেছি সব। অবশ্য ব্যাগের ভার থেকে নিজেকে খুব মুক্ত লাগছিল, একই সাথে রোমাঞ্চিত। মিনিট দশেক যদিও সার্টিফিকেটের চিন্তা মাথা খেয়ে ফেলছিল, কিন্তু একটু পরেই ভেবে দেখলাম সুদূর এই গায়ানাতে কোথাকার কোন ওসমানিয়া ইউনিভার্সিটির খবর কেই-বা রাখে। কাজেই কী আসে যায় তাতে? কিছুই আসে যায়নি। কাজের কাজ যা হয়েছে—নিজের জীবনকে একাকী শুরু করার এক বিরল সুযোগ পেলাম কারও সহায়তা ছাড়াই—ঠিক যেমন আমি চাই। সেটা ছিল ১৯৭৭ সালের কথা। আজ ৩৭ বছর পর ২০১১ সালে এসেও এ ব্যাপারে এক চুলও নড়িনি।

আমার কৈশোর কেটেছে হায়দ্রাবাদে। পঞ্চাশ আর ষাটের দশকে। তখন হায়দ্রাবাদ ছিল পুরোই অন্যরকম এক শহর। দেশের অন্যতম সেরা স্কুল হায়দ্রাবাদ পাবলিক স্কুলে আবাসিক ছাত্র হিসেবে ছয় বছর বয়স থেকে পড়ালেখা শুরু করেছি। আবাসিক ছাত্র হওয়ায় অনেকেই আমার জন্য দুঃখ করছিল; তবে আমি খুবই রোমাঞ্চিত ছিলাম। জীবন ছিল এক অ্যাডভেঞ্চার। বড় হতে হতে আমি ভালোবাসতে শিখি বন-বনানীকে। সে সময় আমার মেনটর হিসেবে পেয়েছি দুজন অসাধারণ মানুষকে—মোহিনি রাজন ও তাঁর ভাই ভেঙ্কট রাম রেড্ডিকে। আন্টি মোহিনি আমাকে শিখিয়েছেন মার্জিত আচার-ব্যবহার। আংকল রাম আমাকে চিনিয়েছেন জঙ্গল। তাদের কাছ থেকেই শিখেছি সততা, ভালোবাসা, নৈতিকতা আর জীবনে কীভাবে আনন্দ করতে হয়।

ঘরে আমার তেমন কোনো জিনিসপত্রই ছিল না। তবে তার কীইবা দরকার যখন আপনার কাছে ঘুরে দেখার জন্য পড়ে আছে পুরো আরাভেলিটাই। গ্রীষ্মের গরমে তাপমাত্রা ৪০এরও ওপরে, শুষ্ক আবহাওয়া, উন্মুক্ত গাছপালা, গাছের শুকনো পাতাগুলো নিচে পড়ে আছে। পা পড়লেই চড়চড় শব্দ করছে। এমন জায়গায় শিকার যদি হাতছাড়া করতে না চান তাহলে আপনাকে পা ফেলতে হবে অনেক সন্তর্পণে। অত্যন্ত সতর্কতার সাথে দত্তি ভাগুর সরোবরের দিকে আমি এগিয়ে যাই। আমি জানি এখানে সবসময়ই পানি থাকে। অনেক দূর-দূরান্ত থেকে জীবজন্তুরা এখানে আসে পানি পান করার জন্য। আপনি যে-ই হন না কেন, পানি তো আপনাকে খেতেই হবে। এক বাবলা গাছের ঝোপের আড়ালে আমি নিজেকে আড়াল করি। গাছের কাটাগুলো এক একটা দু ইঞ্চি করে লম্বা। যেন অপেক্ষা করে আছে আমার গায়ের জামা-কাপড়, আমরা চামড়া-মাংসকে ছিঁড়ে-ফুঁড়ে ফেলার জন্য। তবে বিজ্ঞ লোকের মতো সেই গাছের কিছু শাখা-প্রশাখা কেটে ফেলায় এবং সতর্কতার সাথে সেসব কাটা অংশ সরিয়ে ফেলায় আমি সরোবর থেকে দেখার ও গুলি ছোড়ার মতো দূরত্বে থেকেই নিজেকে আড়াল করতে পেরেছিলাম।

এরপর শুধু বসে বসে নয়ন জুড়ানোর পালা। কী দেখলাম সেখানে? আহ! সে এক ভিন্ন কাহিনি। এখানে বলার জায়গা সেটা না, তবে আপনি যদি আগ্রহী হন তাহলে অন্য একদিন সেই কাহিনি বলা যাবে।

জীবনকে আমি দেখেছি এমন একজন হিসেবে, যে এই জীবনের প্রতিটা মুহূর্তকে কাটিয়েছে প্রবল উৎসাহের সাথে। যেখানেই আমি যখন কোনো কাজ করতাম সেই কাজটাই আমার পূর্ণ মনযোগ ঘিরে রাখত। যার ফলে আজ ৩৫ বছর পরও এখনো অনুভব করতে পারি বারবিস নদীর পাড়ে দোলনা-বিছানায় শুয়ে থাকার স্মৃতি—শুয়ে শুয়ে দোল খাচ্ছি; আমার মুখে পরশ বুলিয়ে যাচ্ছে মৃদু বাতাসের ঝাপটা। সেটা ছিল আমাজনের রেইন ফরেস্টের মধ্যখানে উজানমুখী ৫০ মাইল উপরে; সাথে ছিল কেবল আমার প্রিয় বন্ধু পিটার—কোনোমতে ছিল আর কি! কারণ সে তখন মরার মতো দিব্যি নাক বাজিয়ে ঘুমাচ্ছিল। আধার যখন একটু একটু করে সরে যাচ্ছিল তখন বানরের চিৎকার চেচামেচি শুনতে পাচ্ছিলাম—যেন ঘোষণা দিচ্ছে উষার আগমনের। এক জোড়া ম্যাকাও পাখি একে অপরের সাথে কথা বলতে বলতে সকালের নাস্তার খোঁজে বেরিয়েছে। অদূরে শুনতে পাচ্ছিলাম নদীতে মাছের লাফ দেওয়ার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ। হয়তো কোনো শিকারী থেকে বাঁচার জন্য কিংবা জীবনের সুখের আনন্দে তারা লাফ দিচ্ছে। কে জানে একটা মাছ কেন এভাবে লাফ দেয়!

আমি সবসময়ই সজাগ ছিলাম আমার চেয়ে সুবিশাল কোনো শক্তির ব্যাপারে। যিনি আমাকে দেখছেন, পথনির্দেশনা দিচ্ছেন, রক্ষা করছেন, ঢেকে রাখছেন আমার দোষত্রুটিগুলোকে। রক্ষা করছেন আমার নিজের নির্বুদ্ধিতা থেকে। ধীরে ধীরে এমন এক দিকে আমাকে দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন যেটা আমার জন্য সবসময়ই ভালো কিছু নিয়ে এসেছে।

আমি আমার হৃদয়ের কথা শুনতে শিখেছিলাম। শিখেছিলাম হৃদয় যা বলে সেই কথা বিশ্বাস করতে। মাঝে মাঝে কেবল যা শুনি তার ভিত্তিতেই ঝুঁকি নিতে শিখেছিলাম। এগুলোর সবগুলোর ব্যাপারেই আমি সচেতন ছিলাম; কিন্তু যখন বুঝতে পারলাম এগুলোর পেছেন আছেন কোন সত্তা তখন একে একে সবকিছুই পরিষ্কার হতে লাগল। এখন আমি জিজ্ঞেস করি, আর আমার উত্তর পেয়ে যাই। আমি তাঁর বাণী শুনে আনন্দিত হই। তাঁর সন্তুষ্টি খুঁজি। সেদিনের অপেক্ষায় দিন গুনি যেদিন তাঁর সাথে আমার দেখা হবে। যার সন্তুষ্টি আমার কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তার সাথে দেখা করার চেয়ে আনন্দের আর কীই-বা হতে পারে!

অ্যামাজনের রেইন ফরেস্টের অ্যানাকোন্ডা, জাগুয়ার, বানর, রক্তকণ্ঠী হামিংবার্ড, তাওকান আর ম্যাকও পাখি থেকে শুরু করে দক্ষিণ ভারতের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বনাঞ্চলের হাতি, বাঘ, চিতাবাঘ আর কিং কোবরা—এই ছিল আমার কাছে স্বর্গের ধারণা। কমিউনিস্ট ইউনিয়নের সঙ্গে পাঁচ বছর আকরিক থেকে খনি সংগ্রহ করেছি, পরে দশ বছর ওদের সঙ্গে চা আর রাবার বাগানে কাজ করেছি। ওদের সাথে থাকতে থাকতে নেতৃত্ব দেওয়ার মূলসূত্রগুলো এমনভাবে শিখেছি যেটা ছিল স্বতন্ত্র; যার অন্য কোনো প্রতিরূপ নেই। নিয়মগুলোর কিছু শিখেছি আমি নিজে চর্চা করে, কিছু শিখেছি অন্যদের চর্চা করতে দেখে; এরপর নিজেই লিখেছি নিজের নিয়ম। নিজের জীবন না ক্যারিয়ার—শিখেছি এ ধরনের দোলাচলগুলো কীভাবে ঠিক করতে হয়। শিখেছি কর্তৃত্ব না খাটিয়ে কীভাবে প্রভাবিত করতে হয়। কীভাবে প্রশিক্ষণ দিতে হয়, মীমাংসার উদ্দেশ্যে কীভাবে আলাপ-আলোচনা করতে হয়। কীভাবে ডিঙিয়ে যেতে হয় আপাত দৃষ্টিতে অনতিক্রম্য কোনো বাধা। তবে এগুলো আমি কোনো ক্লাসরুমে শিখেনি। শিখেছি বাস্তব ময়দানে যেখানে প্রতিটা ভুলের জন্য মাশুল দিতে হতো। আমি যদিও খুব একটা ভুল করতাম না। তবে এটা এ কারণে না যে আমি খুব বুদ্ধিমান ছিলাম, বরং এটা একারণে যে, অত ভুল করার মতো অবস্থা তখন আমার ছিল না। প্রত্যেকের জন্যই আমি যে পদ্ধতিটার পরামর্শ দেব সেটা হচ্ছে নিজের জীবন ও কর্মকে ঝুঁকির মুখে রেখে কোনো কিছু যত দ্রুত শেখা যায়, শেখার জন্য তার চেয়ে দ্রুততর কোনো উপায় আর নেই। এমন না যে আমি এগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে করেছি, বরং এটা আমার জন্য করে দেওয়া হয়েছে। আমি ছিলাম অভিনেতা—একটা পাপেট, যার নিয়ন্ত্রণে ছিলেন সবচেয়ে ক্ষমতাশালী, দয়াবান এক সত্ত্বা।

আমি পাঁচটি ভাষায় কথা বলতে শিখেছি, শিখেছি গান গাইতে, ঘোড়া চড়তে ও বশ মানাতে। কুকুরকেও বশ মানাতে শিখেছি। ৫০টনি ক্যাটারপিলার জঞ্জাল সরানোর ট্রাক, বুলডোজার, আর যেসব ট্রাকের সামনে বোঝাই বহন করা হয়—শিখেছি সেগুলো চালাতেও। কোয়াকোয়ামিতে যখন ছিলাম, তখন পাঁচ বছর সেখানে সবচেয়ে দ্রুত অফ-রোডে গাড়ি চালানোর রেকর্ড ছিল আমার। হালাল মাংস খাওয়ার জন্য সপ্তাহে ১২টা করে ষাঁড় জবাই দিতাম। কোয়াকোয়ামিতে আমার থাকাকালীন সময়ে সবাই হালাল মাংস খেতে পারত। উড়ন্ত প্যাটরিজ পাখি কিংবা দ্রুতগতিতে-চলতে-থাকা বন্য শূকরকে কীভাবে শুট করতে হয় শিখেছি সেগুলোও। শিখেছি ট্র্যাকিং আর সংকেত চিহ্ন বুঝতে। জঙ্গলে—যেখানকার অধিকাংশ প্রাণীর জন্যই আমি খাদ্য—তাদের মাঝখানে নিজেকে কীভাবে রক্ষা করতে হয় সেগুলোও আয়ত্ত করেছি। আমি নদীতে নৌকা চালিয়েছি। কখনো শেষ হওয়ার নয় এমন রেইন ফরেস্টের (বিশ বছর বয়সে এমনই মনে হয়েছে) উপর দিয়ে ছোট ছোট বিমানে করে উড়ে বেরিয়েছি। যেকোনো ধরনের রাস্তার উপর দিয়ে ল্যান্ড রোভার চালিয়েছি। আপনার কাছে যখন ফোর-হুইল-ড্রাইভ ল্যান্ড রোভার থাকবে তখন কোনো রাস্তার আবার দরকার পড়ে নাকি! গাড়ির পেছনের কেবিনে শটগান, সমানে পুলি। গাড়ির পেছনের খোলা জায়গাটা করাত, রশি, শেকল, দড়ির দোলনা, বরফের বাক্স, টুলবক্সে ঠাসা। সঙ্গে আমার বন্ধু পিটার। কী জীবনই না ছিল সেটা! তবে আমরা শুধু এগুলোই করে বেরাতাম না, আমরা কাজও করতাম।

বহুকাল পরে, মালয়শিয়াতে, আমি কথা বলছি আন্তর্জাতিক ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাণ্ড মাসজিদে ৯০০০ দর্শকশ্রোতার সামনে। রক্তকণ্ঠী হামিং বার্ড শীতে কীভাবে মেক্সিকো উপসাগর পাড়ি দিয়ে মিসিসিপি পৌঁছায় জুমু’আর খুতবায় বলছি সেগুলো। কীভাবে সম্ভব সেটা? রেইন ফরেস্ট থেকে ঘুরে আসা সেই ছেলেটা, নীলগিরি পর্বতের ঘাসময় ছোট পাহাড় বেয়ে ওঠা সে যুবক কীভাবে আজ শত শত ইসলামিক বিদ্বানদের সামনে সৃষ্টিকর্তার মহিমার ব্যাপারে কথা বলছে? সেটা নিজেই একটা কাকতালীয় ঘটনা, অন্য এক গল্প।

[লিখাটি সিয়ান পাবলিকেশন এর ফেসবুক পেজ এর নোট থেকে নেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তাঁদেরকে উত্তম প্রতিদান দিন।]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *