ফিক্বহশাস্ত্র বিবর্তনের ধারা ও মাজহাবের আগমন-৭ (শেষ পর্ব)

বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম

তাক্বলীদঃ আগমন  

১২৫৮ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ‘আলিমগণ যেকোন ধরনের ইজতিহাদ বন্ধ করে দেন এবং এই সময় তারা এমন একটি নতুন তত্ত্ব দেন যার ফলে ভবিষ্যতেও সকল ইজতিহাদ এর দরজা বন্ধ হয়ে যায়। তাঁরা বলেন, উম্মাহর সকল সম্ভাব্য সমস্যা চিহ্নিত ও তার সমাধানও বের করা হয়ে গেছে (Hypthetical Fiqh এর অতিরিক্ত প্রসারের কারণে তারা এমনটি মনে করেছিলেন)। এজন্য আর কোন ইজতিহাদ এর প্রয়োজন নেই। এই সময় আরেকটি নতুন ধারণা জন্ম নেয় যে, কারও ইসলামের বৈধতার জন্য অবশ্যই চার মাজহাবের কোন একটি মাজহাবকে অনুসরণ করতে হবে। সময়ের সাথে সাথে এই ধারণা শুধু সাধারণ মুসলিমদের মধ্যেই নয় বরং ‘আলিমগণের মধ্যেও বিস্তার লাভ করে এবং তাঁরা দৃঢ়ভাবে এই নীতি গ্রহণ করেন। এভাবে চারটি মাজহাবকে স্বর্গীয় হিসেবে গণ্য করা হতে থাকে এবং সেগুলোর প্রত্যেকটির মাঝে কিছু না কিছু ভুল থাকার পরেও ও একই মাস‘আলায় একটির সাথে আরেকটির অসংখ্য মতপার্থক্য থাকলেও তাদের প্রত্যেকটিকেই সম্পূর্ন নির্ভূল ও প্রকৃত ইসলামের ধারক হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। অতি উৎসাহী কিছু ‘আলিম আবার কিছু কিছু হাদীস নতুনভাবে বাখ্যা করে প্রমাণ করতে চান যে স্বয়ং রাসূল(সা.) চার মাজহাব ও সম্মানিত চার ইমামের আগমন সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বানী করেছিলেন!!! কেউ চার মাজহাবের কোন একটির বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করলে তাকে ‘বিভ্রান্ত’(Heretical) এবং কোন একটি মাজহাবকে অনুসরণ করতে অস্বীকার করলে তাকে ‘মুরতাদ’ বলা হত। এমনকি এও নিয়ম করা হয় যে কেউ কোন একটি মাজহাব থেকে অন্য কোন মাজহাব গ্রহণ করলে তাকে স্থানীয় আদালতে নিয়ে শাস্তি দেওয়া হবে!!

তাক্বলীদঃকারণ 

 (১) Hypothetical Fiqh এর মাত্রাতিরিক্ত প্রসারের কারণে প্রতিটি মাজহাবেই বাস্তব ও সম্ভাব্য অসংখ্য খুঁটিনাটি মাস‘আলা ও সেগুলোর সমাধান নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা ও সমাধান লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল। এজন্য ‘আলিমগণ ধারণা করতে থাকেন এমন কোন সমস্যা আর নেই যা ভবিষ্যতে আসবে কিন্তু তার সমাধান বের হয়নি। তাই তাঁরা ইজতিহাদ বন্ধ করে দেন এবং ভবিষ্যতে ইজতিহাদ এর সকল সুযোগও বন্ধ করে দেন।

(২) আব্বাসীয় খিলাফতের পতনের পর মুসলিম সাম্রাজ্য অনেকগুলি ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এসব রাষ্ট্রের নব্য শাসকবৃন্দ ইসলামী জ্ঞানের বিস্তার ও ইসলামী আইন অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনার চেয়ে নিজ স্বার্থ হাসিলেই ব্যস্ত ছিলেন।

(৩) প্রতিটি রাষ্ট্রের অধিকাংশ মুসলিম একটি নির্দিষ্ট মাজহাব অনুসরণ করা শুরু করে। এর ফলে ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্রে ভিন্ন ভিন্ন মাজহাব প্রধান মাজহাব হয়ে উঠে এবং কোন রাষ্ট্রের বিচারক পদে ঐ মাজহাবের লোক নিয়োগ দেওয়া হতে থাকে। তাই বিচারক পদে যারা আসতেন তাদেরকে বাধ্যতামূলকভাবে রাষ্ট্রীয় মাজহাব অনুসরণ করতে হত।

(৪) কিছু অযোগ্য মানুষ তাদের ইচ্ছামত মূল ইসলামকে বিকৃত করার জন্য ইজতিহাদ এর নামে বিকৃত ফতোয়া দিতে শুরু করে। একারণে তৎকালীন সময়ের কিছু উল্লেখযোগ্য ‘আলিম শারী‘আহকে বিকৃতির হাত থেকে বাঁচানোর জন্য ইজতিহাদ এর দরজা বন্ধ করে দেন।

 তাক্বলীদঃআমাদের করণীয়   

আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্মের ফিক্বহ বিষয়ক গবেষণার হাত ধরেই আমাদের গবেষণা ও অনুসরণ চলবে কোন সন্দেহ নেই। কুরআন ও হাদীসের অর্থ ও তাৎপর্য বোঝা, মানা ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে তাঁরাই ছিলেন অগ্রগামী।  বিশেষত প্রথম তিন প্রজন্মের (সাহাবী, তাবিঈ ও তাবা তাবিঈ) ‘আলিমগণ ছিলেন এ ব্যাপারে সবচেয়ে এগিয়ে। কিন্তু তাঁরাও মানুষ ছিলেন এবং আমরা বিশ্বাস করি একমাত্র রাসূল(সা.) ব্যাতীত কেউই ভূল এর ঊর্ধে নয়। তাই তাঁরাও ইজতিহাদ এর ক্ষেত্রে ভূল করতে পারেন এবং তবুও নিয়্যতের বিশুদ্ধতার জন্য তাঁরা একটি সওয়াব পাবেন। তাই আমরা অবশ্যই তাঁদেরকে অনুসরণ করব কিন্তু তাঁদের ভুলগুলিকে শ্রদ্ধার সাথে এড়িয়ে যাব, এ নিয়ে অনর্থক তর্ক-বিতর্ক করব না এবং এসব ক্ষেত্রে তাঁরা মা’জূর বলে ধরে নিব। এই বিষয়ে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জাম‘আহ এর আক্বীদা ইবনু কুদামা আল মাকদিসি (রহিমাহুল্লাহ) তাঁর “লু’মাতুল ‘ইতিক্বদ” (ইংরেজী অনুবাদ-The Radiance of faith) গ্রন্থে লিখেছেন-

“94. As for a leading scholar in the secondary principles of the religion, like the Four Denominations, they are not objectionable. For differences in secondary legal issues is a mercy… … [means it is within the mercy of Allah]

তাক্বলীদ মানে যদি হয় ‘সকল মাস’আলায় অন্ধভাবে দলীল ছাড়াই কোন একটি মাজহাবের অনুসরণ করা’ তবে একজন মুসলিমের উচিত নয় এমন কিছু করা। আবার একজন সাধারণ মুসলিম, যার নিজে থেকে কুরআন-হাদীস থেকে ইজতিহাদ করার যোগ্যতা নেই তারও উচিত নয় নিজে থেকে মাস‘আলা বের করা। একজন সাধারণ মুসলিম যেকোন সমস্যার সমাধানে তাঁর কাছে Available একজন নির্ভরযোগ্য ‘আলিম এর কাছে যাবেন এবং দলীল প্রমাণ সহকারে যেকোন উত্তর জেনে নিবেন। কোন কারণে উক্ত ‘আলিম দলীল-প্রমাণ নিজে থেকে না বললে সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তি জিজ্ঞেস করে জেনে নিবেন এবং এই ব্যাপারে কোনরকম জড়তা রাখবেন না। ‘আলিমগণেরও উচিত নয় কেউ দলীল জানতে চাইলে রেগে যাওয়া বা অস্বীকৃতি জানানো। যেকোন সাধারণ মুসলিম খোলা মনে ও উদার মানসিকতায় তাঁর কাছে Available দলীল ও ‘আলিম এর অনুসরণ করবেন এবং কোন মাস‘আলায় পরবর্তীতে অধিক নির্ভরযোগ্য কোন দলীল বা মত পেলে নিঃশঙ্কচিত্তে পুর্বের মত ছেড়ে পরের মত অনুসরণ করবেন এবং সর্বোপরি আল্লাহর কাছে আমৃত্যু হিদায়াত প্রার্থনা করে যাবেন।

[# এই সিরিজের সকল লিখা ডঃ বিলাল ফিলিপস এর The Evolution of Fiqh বইটির নির্বাচিত অংশের সরল ভাবানুবাদ। আল্লাহ তাঁকে দুনিয়া ও আখিরাতে উত্তম জাযা দান করুক এবং মাজহাব সংক্রান্ত ভ্রান্তি দূরীকরণের এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা কবুল করে নিক। আমিন]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *