নিঃসন্তান বিড়ম্বনাঃ দম্পতি না সমাজ ?

‘একটি শিশুর জন্মের সাথে সাথে একটি মায়েরও জন্ম হয়’ কথাটা একসময় বইয়ে পড়েছিলাম,এখন অনুভব করি প্রতিদিন। আর এই মায়ের জন্মের পুরো প্রক্রিয়াটি যতটা কঠিন, ঠিক ততটাই শিক্ষার। আমার ফাতিমা’র জন্মের আগের, জম্মের সময়ের ও পরের কিছু বাস্তব অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখবো ভেবেছিলাম। শুরুটা করা যাক, বি ইযনিল্লাহ।

আমাদের বিয়ে আর বাবুর জন্মের মাঝে সময়কাল খুব বেশিনা, দেড় বছরের মত। এই দেড় বছরেও আবার ফাইনাল প্রফ নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম এক বছরের বেশি। সন্তানহীন অবস্থায় ছিলাম বোধহয় ছ’মাসের মত, তাও দুজনে দুই প্রান্তে: ঢাকা- রাজশাহী। এই অল্পবিস্তর সময়েই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা জীবনের একটা বড় শিক্ষা দিয়েছেন: what the feelings & sufferings of childless parents is!

জীবনের কোন পর্যায়ে এমনকি কঠিনতম সময়ে দাড়িয়েও আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল জিনিসটা হারিয়ে যায়নি, আলহামদুলিল্লাহ। তাই যখন থেকে মা হতে চাই বলে মনস্থ করেছি, তারপর সেটা কবুলিয়াতে সামান্য দেরি হলেও তা নিয়ে চিন্তিত তেমন হইনি। কারণ, এটা খুব বেশি সত্য যে আল্লাহ যখন চান তখনই কেবল সন্তান আসতে পারে, তার আগেও নয় পরেও নয়। মানুষের অনিচ্ছা সত্ত্বেও আল্লাহর ইচ্ছায় অনেক কাপলের অজান্তেই সন্তানের নিউজ চলে আসে, আবার অনেক কাপলকে চাওয়া সত্ত্বেও বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হয়। যার রিযক্ব যখন লেখা আছে, তার আগে সে আসবে কি করে??

অথচ এই ধ্রুব সত্যটুকু মানতেই আমাদের সমাজ বড্ড নারাজ। যাদের সন্তান তারা অপেক্ষা করতে রাজি থাকলেও আমাদের পরিবার-পরিজন, পাড়া- প্রতিবেশীদের এ নিয়ে চিন্তার অন্ত নেই দশা। ঐ অল্পদিনের অপেক্ষাতেই আত্মীয়-পরিজনের কাছে যে পরিমাণ প্রশ্নবাণে বিদ্ধ হয়েছি, তাতেই অনেক শিক্ষা হয়েছে, আলহামদুলিল্লাহ।
– বিয়ের দু’বছর হয়ে গেলো, ওরা এখনো বাচ্চা নেয়না কেন?
– ওরা কি বাচ্চা নেয়না, না হচ্ছেনা?
– না-ই যদি হয়, তাহলে ডাক্তার দেখায়না কেন? (ডাক্তার দেখানোর প্রয়োজনীয়তা যে তখনো হয়নি, সে কথা কে কাকে বুঝাবে!)
– ওরা এত স্থির হয়ে আছে, বাচ্চা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা নাই কেন??

আরও কত কত প্রশ্ন…..
শুধু কি তাই! কিছুদিন পরপর ইনারা আবার ফোন করে ফলো আপ নেন: বাচ্চাকাচ্চার খবর কী??

বলি, বাচ্চাকাচ্চা কি গাছে ধরে যে চাইলেই পাওয়া যায়? নাকি ক্ষমতাটা মানুষের হাতে আছে, ইচ্ছে হলেই জন্ম দেয়া যায়? চাইলেই দুদিন পরপর খবরের আপডেইট দেয়া যায়?

ফেইসবুকে একটা লেখা পড়েছিলাম একবার: যাদের বিয়ে হচ্ছেনা, তাদেরকে বার বার বিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করা কিংবা যে কাপলের বাচ্চা হয়নি তাদেরকে বার বার বাচ্চার খবর জিজ্ঞাসা করাটা অনুচিত। এই কাজটা যে কতটা অনুচিত, তা নিজে ফেইস করেই টের পেয়েছি। আমি নিজে যতটুকু টের পেয়েছি তারচে বেশি উপলব্ধি করেছি: যারা বছরের পর বছর নিঃসন্তান অবস্থায় ধৈর্য ধরে আছেন, তাদেরকে না জানি কত লম্বা পরীক্ষার পথ পরিক্রমা পাড়ি দিতে হচ্ছে!

এটাও সত্য যে, শুভাকাঙ্ক্ষীরা আমাদের ভালো চান বলেই খোজ নিয়ে থাকেন। কিন্তু বার বার খোজ নিতে গিয়ে এমন বিষয়ে কাউকে কষ্ট দেয়া কিংবা ওভারপ্রেশার ক্রিয়েট করার কোন মানে হয়না, যে বিষয়ের সিদ্ধান্ত মানুষের হাতে নেই, বরং আল্লাহর হাতেই পুরোটা। আর আল্লাহর সিদ্ধান্তই মানুষের জন্য সর্বোত্তম। ইসলামের ইতিহাসে আমরা দেখতে পাই, আল্লাহ তার প্রিয় নবী-রাসূলদেরকে পর্যন্ত সন্তান না দিয়ে পরীক্ষা করেছেন। সুতরাং, যাদের সন্তান আছে তাদেরই আল্লাহ ভালোবাসেন, তারাই সৌভাগ্যশালী এমন নয়; বরং আল্লাহ যাদেরকে বেশি ভালোবাসেন, তাদেরকেই বড় বড় পরীক্ষা নিয়ে থাকেন। আল্লাহ তার হাবীব রাসূলুল্লাহ সা: কেই জীবিত পুত্রসন্তান দেননি, যা নিয়ে মুশরিকরা তাকে ‘লেজকাটা’ বলে পর্যন্ত উপহাস করেছে…

আমাদের সমাজটা কেন যেন খুব অস্থির, মানুষগুলো বড় বেশি অস্থিরচিত্ত। কাউকে কোন পরীক্ষায় আপতিত হতে দেখলে আমরা প্রথমেই তার ব্যাপারে একটা নেগেটিভ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে যাই, অথচ আল্লাহ খারাপ ধারণা করতে কঠিনভাবে নিষেধ করেছেন। কুরআনে বার বার বলা হচ্ছে পরস্পরকে সবরের উপদেশ দিতে, সেখানে কাউকে কোন নি’আমতবঞ্চিত হতে দেখলে তাকে সবরের উপদেশ দেওয়া, আল্লাহর সিদ্ধান্তে আস্থা রাখার উপদেশ না দিয়ে আমরা বরং তার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে সচেষ্ট হই- কোন কোনভাবে সে বঞ্চিত হয়েছে, কোন কোন দিক দিয়ে সে অন্যদের চাইতে অসুখী। কাউকে সবরের উপর ইস্তেক্বামাত করতে দেখলে তাকে উৎসাহ না যুগিয়ে বরং সে কেন চিন্তিত হয়ে কান্নাকাটি, হা-হুতাশ করছে না, সেটা নিয়ে নিজেরাই চিন্তিত হয়ে পড়ি। গতানুগতিক এই ট্রেন্ডটা পরিবর্তন হওয়া জরুরী।

যাহোক, আবার মূল গল্পে ফিরে আসি। যখন সবাই আমাদের সন্তান নিয়ে এতই চিন্তিত, এতই অস্থির, তখন আমরা পজিটিভ/নেগেটিভ দুটো ধরে নিয়েই স্থির থেকে আল্লাহর কাছে একটা দু’আ করেছিলাম:
‘ইয়া আল্লাহ! আমাদেরকে নিঃসন্তান রাখা যদি আপনার সিদ্ধান্ত হয়, এর মধ্যেই আমাদের কল্যাণ রাখেন, তাহলে সেই অবস্থার উপরই আমাদের সন্তুষ্ট রাখুন। আর যদি সন্তান দিতে চান, তবে আমাদের মৃত্যুর পর সাদাক্বায় যারিয়াহ হয়, এমন একটা সন্তান আমাদের দান করুন। আমাদের দুনিয়া ও আখিরাতের জন্য ফিত্নার বস্তু হয় এমন সন্তান আমাদের দিয়েন না।’ অবশেষে আল্লাহ আমাদের দ্বিতীয় দু’আটিই কবুল করে নিলেন। তাওয়াক্কুল ও ধৈর্যের বিনিময় উত্তম, অধৈর্য হয়ে হা-হুতাশ করে আসলে একূল-ওকূল কোন কূলেই যে লাভবান হওয়া যায়না, আরেকবার প্রমাণ পেলাম, ফালিল্লাহিল হামদ।
যারা অস্থির হয়ে গিয়েছিল, তারাও বোধহয় জানতে পারলো: আল্লাহর সিদ্ধান্ত অবধারিত, অস্থির না হয়েও সে সিদ্ধান্তের অপেক্ষা করা যায়….

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *