সহনশীলতা কিংবা মধ্যমপন্থা কী জিনিস? আচ্ছা, আমার মতটা একটু ব্যাখ্যা করি। কলেজ লাইফে একটা সময় আমিও হিজাবী ছিলাম, নিক্বাব করার ইচ্ছে থাকলেও করতে পারতাম না। চলাফেরার সুবিধার জন্য শর্ট বোরখা পরতাম। যাহোক, কোন একটা ধর্মীয় জামাতের সাথে কাজ করা শুরু করার পর সেখানকার আপুরা সবসময় বোঝাতেও নিক্বাবের গুরুত্ব কী? তো একটা আপু একটা কথা বলেছিলেন যেটা খুব দাগ কেটেছিলো মনেঃ
দেখো আপু, তুমি যখন মানুষের কাছে দ্বীনের আদর্শ, তোমার নিজের ক্ষেত্রে বেস্ট জিনিসটা দেখাতে হবে। কারণ মানুষ কথায় শেখেনা, দেখেই শেখে। তুমি ইসলাম সম্পর্কে জেনেবুঝেও যদি শর্ট বোরখা পরো, তোমার রেফারেন্স দিয়ে হয়তো মানুষ স্কার্টের উপর হিজাব পরা শুরু করবে। তুমি যদি হিজাব করো, নিক্বাব না করো, তোমাকে দেখে হয়তো মানুষ আরেকটু কালারফুল রংচঙ্গে হিজাব করা শুরু করবে। মানুষ স্বভাবতই এমন, নিজের জন্য সহজ জিনিসটাই বেছে নিতে যায়, আর তাতে ইসলামিক কারো রেফারন্স পেলে আরও সহজ হয়ঃ ‘অমুক আপু তো এত জেনেবুঝেও এতা করে, আমি একটু এমন করলে দোষ কী?’ আমরা যারা দাওয়াতের কাজ করি, তারা মানুষের প্রতি কঠোর না হলেও নিজের ক্ষেত্রে কঠোর হওয়াই উচিৎ। দেখো, উম্মুল মু’মিনীনরাই তাঁর উদাহরণ, উনাদের ক্ষেত্রে পর্দার বিধান আমাদের চেয়েও কঠিন ছিলো, তাঁর পেছনে হিকমাহ এটাই- উনারা গোটা নারীজাতির জন্য আদর্শ ছিলেন……
আপুর এই কথাটা আজও মাথায় কোডেড হয়ে আছে। আর যে যেটাই বলুক না কেন, এটা বাস্তব সত্য যে, যাদের কাছে থেকে মানুষ দ্বীনি ইলম শিখতে চায়, কিংবা যাদের কাছে মানুষ দাওয়াহ পায়, তাদেরকে লিবাসে ও মননে ‘ইসলামিক’ বলে বোঝা যায়, এমনটাই এক্সপেক্ট করে। বিলাল ফিলিপস রহিমাহুল্লাহও এই কথাই বলেছেনঃ টুপি পরলে যদি বক্তার প্রতি শ্রোতার সম্মান বেশি হয়, তার কথা শুনতে চায় মানুষ, তবে সেখানে মুসলিম দা’ঈর টুপি পরাই উচিৎ। এবং উনি নিজেও এটা পরে থাকেন।
এবার আসি সহনশীলতা প্রসঙ্গেঃ কেউ ব্যক্তিগতভাবে কঠোর ফতোয়া কিংবা কোন বিষয়ে মেজরিটি উলামার ফতোয়া অনুসরন করেন বলেই মনে করে নেয়া যাবেনা, সে সহনশীল না। অনুসরণ এক জিনিস, আর সহনশীলতা এক জিনিস। বিধানের ব্যাপারে আল্লাহর রাসূল যেমন কঠোর ছিলেন, তেমন তার কাছে সাধারণের সহজগম্যতাও এমন ছিলো যে এসে মানুষ এসে তাঁর কাছে যিনা করার অনুমতিও চাইতে পারতো। তিনি হয়তো রেগে গিয়ে তাকে প্রহার করতে উদ্যত হননি, বরং তার অবস্থান থেকে বোঝার চেষ্টা করেছেন, তাকে হতাশ না করে সুন্দরভাবে তার সমাধানের একটা পথ বাতলে দিয়েছেন, কিন্তু তাই বলে তিনি যিনাকে ‘হালাল’ বলেননি, এমনটাও বলেননিঃ বেশ তো, যিনা করে এসো, আল্লাহ মাফ করে দেবেন। কিংবা কোন কোন আলিমের মতে যিনা হালাল কিংবা মাকরূহ। এত কঠোরতার কিছু নেই….(না’উযুবিল্লাহ)
আবু বকর রাঃ এত কোমল দীলের মানুষ, অথচ তিনি যাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন, আল্লাহু আকবার! তিনিও তো পারতেন এত কঠোর না হয়ে সবার সাথে পরামর্শ করে আরেকটু সহজ মত দিতে!! (না’উযুবিল্লাহ)
স্পষ্ট হালাল- হারামের ব্যাপারে কঠোরতা অবলম্বন মানেই অসহনশীলতা নয়, যেসব বিষয়ে আলেমদের মধ্যেই বিস্তর ইখতিলাফ, সেগুলোর ব্যাপারে সহনশীল হওয়াই শ্রেয়, কিন্তু মেজরিটি আলেম যেখানে একমত, সেখানে মেজরিটি বাদ দিয়ে দিয়ে নিজের সুবিধা অনুযায়ী সহজতার পক্ষ নেয়া সমীচীন মনে করিনা, নিজের জীবনে প্রয়োগ না করতে পারলেও ‘সত্যটা সত্যই’, আমি না পারলেও সত্য, এমনটাই মনে করি।
আর হ্যা, আমার এইটুকু জীবনেই আমি এমন অনেক অনেক মানুষকে দেখেছি, যারা প্রতি পদে পদে সহজতার ফতোয়া খুজতে খুজতে, সেই অনুযায়ী নিজের জীবনকে সমাজ ও স্রোতের সাথে মেলাতে মেলাতে কখন যে নিজেরাই ‘ইসলামিক কমিউনিটি’ থেকে দূরে সরে সাধারণ কমিউনিটির সাথে একাত্ম হয়ে গেছেন, নিজেরাও টের পাননি। হ্যা, তারা কেউই অজ্ঞ ছিলেন না, দ্বীন সম্পর্কে আমার চেয়ে বেশি ছাড়া কম জানতেন না, কিন্তু নাক্বলের উপর আক্বলের স্থান দিতেন। তেমন পরিনতি চাইনা, আল্লাহ আমাদের হিফাজত করুন।