একবার তাব্লীগ নিয়ে আলোচনায় ভাইয়া বলছিলো: আমাদের তাব্লীগীদের তো আবার ‘ওয়াহাবি’ বলে গাল দেয় অনেকে। আমি বললাম: তাই নাকি? আমি তো শুনেছি, এই গালি সালাফীদেরকে দেয়া হয়।
প্যাচ লেগে গেলো, আসলেই ‘ওয়াহাবি’ গাল কাদের দেয়া হয়? আর ওয়াহাবিদের ব্যাপারে যে বদনাম, তা কি আসলেই সত্য না অপবাদ?? বহুদিন ধরেই নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গিতে লেখা একটা বই খুঁজছিলাম। আলহামদুলিল্লাহ, ‘ইসলামি বই’ গ্রুপের কল্যাণে পেয়েও গেলাম:
মাওলানা মনযুর নোমানী রহ. এর “ওয়াহাবি আন্দোলন ও উলামায়ে দেওবন্দের মূল্যায়ন”।
বইটা পড়ে আশার চেয়ে বেশি উপকৃত হয়েছি, আলহামদুলিল্লাহ। অন্তত আমার মত ‘ওয়াহাবি’ টার্মটা যারা কোনদিন শুনেছেন কিন্তু জানেন না ‘ইহা খায় না মাথায় দেয়’ তাদের জন্য বইটি পড়া খুব জরুরী। আর হ্যা, খুব ভালো লেগেছে যেটা: বইটিতে আকাবির উলামায়ে দেওবন্দ ও আকাবিরে সালাফি(আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা’আহ) দের মধ্যকার মিল ও মতপার্থক্য নিয়ে খুবই ব্যালেন্সড একটা আলোচনা এসেছে, যেটা এ যুগের ‘কাদা ছোড়াছুড়ি’ ফ্যানাটিক মুসলিম দলবাদীদের পড়া খুব প্রয়োজন, যারা ভিন্নমতাবলম্বীদের পারলে তাকফীর করে বসেন।
ওয়াহাবি আন্দোলনের নেতা মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল ওয়াহহাব নজদী সম্পর্কে যে অপবাদগুলো প্রচলিত, তা মূলত আহমদ রেজা বেরেলভী কিংবা কবরপূজারী, মাজারপূজারীদের অপপ্রচার ও তাতে হারামাইন শরীফের আলিমদেরও ব্রেইন ওয়াশ করাটাই ছিলো মূল কারণ, যার প্রভাবে প্রভাবান্বিত হয়েই মাওলানা খলিল আহমদ সাহারানপুরী রহ. ১৩২৫ হিজরিতে ‘আত-তাসদিকাত’ পুস্তিকায় কিংবা সাইয়েদ হুসাইন আহমদ মাদানী রহ. তার ‘শিহাবুস সাকিব’ গ্রন্থে ওয়াহাবি আন্দোলনের যে কঠোর সমালোচনা করেন, তার দু’দশক পরে উনারাই যখন মদীনা মুনাওয়ারায় থিতু হয়ে নজদবাসীদের জীবনযাত্রা প্রত্যক্ষ করেন কিংবা ওয়াহাবি আলিমদের ব্যক্তিগত সান্নিধ্যে আসেন, উনাদের মতামত পুরোটাই বদলে যায়, যা তাদের পরবর্তীকালীন কিছু লেখা ও চিঠিতে প্রতিফলিত হয়েছে।
শাইখ মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহহাব সম্পর্কে লেখকের নিজস্ব অভিমতটুকু লিখে শেষ করি:
আমি আমার অধ্যয়নের আলোকে নির্দ্বিধায় এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, কোন ব্যক্তি যদি আল্লাহর তাউফীকে কুরআন কারীম ও রাসূলুল্লাহর খালেস তাওহীদের আহ্বানের মর্ম বোঝেন, যদি এগুলোর প্রতি তার ভালোবাসা ও অনুরাগ থাকে, যদি শিরক-বিদাত ও সেগুলোর প্রতি তার মনে ঘৃণা-বিদ্বেষ ও বৈরিতা থাকে সে ব্যক্তি অবশ্যই শায়খ মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহহাবের দাওয়াত ও মেহনতের সঙ্গে আদর্শিক ও বুনিয়াদি দৃষ্টিকোণ থেকে একমত হবেন। তার মতাদর্শ ও দ্বীনের ব্যাপারে তার চিন্তাধারা বুনিয়াদিভাবে শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ ও তার শিষ্য হাফেয ইবনুল ক্বায়্যিম রহ. এর সঙ্গে মিলে যায়। আর এই দুই মনীষীর ব্যাপারে আমাদের আসাতিযায়ে কিরাম ও আকাবির রহ. এর অবস্থান হলো, তাদেরকে উম্মাহর আকাবির উলামা মনে করা হয়, তাদের নাম শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রমের সঙ্গে স্মরণ করা হয়। তারা হাম্বলি ফিকহের অনুসারী ছিলেন, তবে তারা যদি হাম্বলি ফিকহের কোন মাসয়ালা সহীহ হাদীসের পরিপন্থী পেতেন, তাহলে তারা সেই মাসয়ালা পরিত্যাগ করে হাদিসের অনুসরণ করতেন। শাইখ মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহহাব সেই মতাদর্শ ও চিন্তাধারার অধিকারী ছিলেন।
নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে তার সেই চিন্তাধারা ও মতাদর্শ আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের হানাফি উলামায়ে কিরামের পুরোধা, উসতাযুল আসাতিযা হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভি রহ. এর সঙ্গে শতভাগ মিলে যায়। যারা শাহ সাহেবের রচনাবলির মধ্যে হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগা, মুসাওয়া, মুসাফফা, ঈকদুল জীদ, ইনসাফ প্রভৃতি অধ্যয়ন করেছেন, তাদের চোখে সেই মিল ও সাদৃশ্য সহজেই ধরা পড়বে।
আল্লাহ তা’আলা অনুবাদক আব্দুল্লাহ আল ফারুককে উপযুক্ত জাযা দিন।