Law of Attraction: নিউ এইজ স্পিরিচুয়ালিটি ও কোয়ান্টাম তত্ত্বের আরেক ভেল্কি

চলুন জেনে নিই ল’ অব এট্রাকশনের আদ্যোপান্ত এবং এ ব্যাপারে ইসলামের অবস্থান কী….

Law of Attraction কী?

New Age Spirituality অনুযায়ী ব্যাখ্যা Law of Attraction বা আকর্ষণের সূত্র হলো এমন একটি ধারণা যা বলে— মানুষ তার চিন্তা, অনুভূতি এবং মনোযোগের মাধ্যমে নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা তৈরি করে। অর্থাৎ, তুমি যা ভাবো, বিশ্বাস করো এবং মনোযোগ দাও— তা-ই তোমার জীবনে আকর্ষিত হয়। New Age Spirituality এই ধারণাকে একটি Universal Law বা মহাবিশ্বের নিয়ম হিসেবে ব্যাখ্যা করে।

Law of Attraction শুধু অলৌকিক প্রক্রিয়া নয়, এটি মানুষের মনের গভীর প্রোগ্রামিং-এর অংশ। যখন তুমি কোনো বিষয়ে মনোযোগ দাও, তোমার মস্তিষ্কের Reticular Activating System (RAS) সেই বিষয় সম্পর্কিত তথ্য বেশি চিনে নেয়। ফলে তোমার চিন্তা, আচরণ ও সিদ্ধান্ত বাস্তবে সেই দিকেই পরিচালিত হয়।

Law of Attraction বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়— অর্থ, সম্পর্ক, স্বাস্থ্য ও সাফল্যে। উদাহরণস্বরূপ, কেউ যদি প্রতিদিন কল্পনা করে যে সে সফল উদ্যোক্তা, ইতিবাচকভাবে কাজ করে, কৃতজ্ঞ থাকে এবং আত্মবিশ্বাস ধরে রাখে, তাহলে ধীরে ধীরে তার আচরণ ও সিদ্ধান্তগুলো সেই সফল বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে ওঠে।

New Age Spirituality-র অনেক শিক্ষক ও লেখক এই ধারণা জনপ্রিয় করেছেন। Rhonda Byrne “The Secret” বই ও চলচ্চিত্রের মাধ্যমে এটি বিশ্বজুড়ে পরিচিত করেন। Bob Proctor, Esther Hicks, এবং Dr. Joe Dispenza এই সূত্রকে ব্যক্তিগত বিকাশ, মানসিক শক্তি এবং energy alignment-এর সঙ্গে যুক্ত করেছেন।

তাদের মতে, Law of Attraction হলো এমন এক সচেতন জীবনধারা যেখানে মানুষ নিজের চিন্তা ও অনুভূতির দায়িত্ব নেয় এবং Universe-এর শক্তির সঙ্গে সুর মিলিয়ে চলে। তারা বলে-

“You are the creator of your own reality.”

অর্থাৎ, তোমার জীবনের বাস্তবতা তুমি নিজেই তৈরি করো, তোমার চিন্তা ও কম্পনের মাধ্যমে।

মূল নীতি (Core Principles):

1. Like attracts like — তুমি যেমন ভাববে, তেমনই জিনিস তোমার জীবনে আসবে। অর্থাৎ, যেমন চিন্তা, তেমন ফলাফল। মহাবিশ্বে সবকিছুই শক্তি (Energy)। তোমার চিন্তা, অনুভূতি, এমনকি শব্দ পর্যন্ত শক্তির একেকটি তরঙ্গ বা vibration। তুমি যদি ইতিবাচক কম্পনে থাকো (high vibration), তাহলে সেই শক্তি একই ধরনের ইতিবাচক অভিজ্ঞতা আকর্ষণ করে। আর যদি তোমার চিন্তা ভয়, ঘৃণা বা দুঃখে নিমজ্জিত হয় (low vibration), তাহলে জীবনে নেতিবাচক অভিজ্ঞতা বাড়ে। উদাহরণ: তুমি যদি বিশ্বাস করো তুমি সফল হবে, তোমার মন ও কাজ সেই দিকেই কাজ করবে।

2. Thoughts become things — চিন্তাই বাস্তবতা সৃষ্টি করে।

মানে, তোমার চিন্তার ধারাই তোমার বাস্তব জীবন গড়ে দেয়।

3. Ask, Believe, Receive — তিন ধাপে আকর্ষণ প্রক্রিয়া।

i) Ask (চাও): তুমি যা চাও, সেটি স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করো এবং Universe-এর কাছে অনুরোধ করো।

ii) Believe (বিশ্বাস করো): বিশ্বাস রাখো যে Universe ইতিমধ্যেই তোমার অনুরোধ গ্রহণ করেছে। কোনো সন্দেহ রেখো না।

iii) Receive (গ্রহণ করো): কৃতজ্ঞতা ও ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে অপেক্ষা করো ফল পাওয়ার জন্য।

উদাহরণ

ধরো, তুমি প্রতিদিন মনে মনে ভাবছ —

“আমি একদিন নিজের ব্যবসা শুরু করব, আমি সফল উদ্যোক্তা হব।”

তুমি এই চিন্তাটা বারবার অনুভব করছ, নিজেকে সেই অবস্থায় কল্পনা করছ — তখন তোমার মন, কাজ, এমনকি আশেপাশের সুযোগগুলোও ধীরে ধীরে সেই দিকে কাজ করতে শুরু করবে।

New Age দৃষ্টিতে বলা হয় — “Universe তোমাকে সেই vibration অনুযায়ী সুযোগ পাঠাবে।”

অন্যদিকে, যদি তুমি বারবার ভাবো “আমি পারব না”, “আমার ভাগ্য খারাপ” — তাহলে সেই নেতিবাচক vibration তোমার জীবনে একই ধরণের পরিস্থিতি টেনে আনবে।

প্র্যাকটিস বা প্রয়োগের কৌশল:

১. Vibration বা Frequency — প্রতিটি চিন্তা ও অনুভূতি একেক ধরনের কম্পন তৈরি করে। ভালোবাসা, আনন্দ ও কৃতজ্ঞতা উচ্চ কম্পন; ভয়, রাগ ও হতাশা নিম্ন কম্পন। তুমি যে কম্পনে থাকবে, তোমার বাস্তবতাও সেই অনুযায়ী গড়ে উঠবে।

২. Visualization বা চিন্তার চিত্রায়ণ — তোমার লক্ষ্যকে চোখের সামনে বাস্তবের মতো কল্পনা করা। তুমি যদি এমনভাবে কল্পনা করো যে তুমি ইতিমধ্যেই সেই জিনিস পেয়েছো, তাহলে Universe সেই বাস্তবতা তৈরি করতে শুরু করবে।

৩. Affirmation — ইতিবাচক বাক্য বারবার উচ্চারণ করা, যাতে অবচেতন মন নতুন বিশ্বাস গ্রহণ করে। যেমন: “I am confident.”, “I attract abundance.”

৪. Gratitude বা কৃতজ্ঞতা — কৃতজ্ঞতা প্রকাশকে বলা হয় সবচেয়ে শক্তিশালী vibration। তুমি যত বেশি কৃতজ্ঞ থাকবে, Universe তত বেশি আশীর্বাদ তোমার জীবনে টেনে আনবে।

৫. Positive focus — নেতিবাচক চিন্তা এড়িয়ে চলা, কারণ তা বিপরীত জিনিস আকর্ষণ করে।

ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে Law of Attraction:

Law of Attraction এর সাথে ইসলামী চিন্তার কিছু মিল রয়েছে, এগুলোকে উপজীব্য করেই অনেকে এই তত্ত্বকে ইসলামিক দাবি করতে চায়। যেমন-

১. ইতিবাচক চিন্তা ও আশা রাখা:

ইসলামও শেখায় যে মুমিনকে সবসময় আশাবাদী হতে হবে এবং আল্লাহর প্রতি ভালো প্রত্যাশা রাখতে হবে। আল্লাহ বলেন-

«إِنَّ عَبْدِي ظَنَّ بِي ظَنًّا فَأَنَا لَهُ»

অর্থ: “আমার বান্দা যদি আমার সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখে, আমি তেমনি তার সাথে আচরণ করি।” (তিরমিজি 2516)

২. কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ প্রকাশ:

ইসলাম কৃতজ্ঞতাকে (শুকর) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। আল্লাহ তাকে যা দিয়েছেন, তার ব্যাপারে শোকর আদায় করতে হবে। বিপদে সবর ও আনন্দে শোকর করতে হবে। আল্লাহ বলেন-

«لَئِنْ شَكَرْتُمْ لَأَزِيدَنَّكُمْ»

অর্থ: “যদি তোমরা কৃতজ্ঞ হও, আমি অবশ্যই তোমাদেরকে বৃদ্ধি দেব।” (সূরা ইব্রাহিম 14:7)

অথচ Law of Attraction এর সাথে ইসলামের কঠিন কিছু সংঘর্ষ আছে, যা বিশ্বাস করলে ঈমান চলে যেতে পারে। সেগুলো হলো —

১. মানুষের ইচ্ছা পূরণ করে Universe বা cosmic energy:

LoA বলে Universe ইচ্ছা পূরণ করবে। ইসলাম স্পষ্টভাবে বলে, সবকিছু আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী ঘটে। ইউনিভার্সের নিজস্ব কোন শক্তি নেই, তা আল্লাহর নির্দেশেই চালিত হয়।

আল্লাহ বলেন-

«وَمَا تَشَاءُونَ إِلَّا أَنْ يَشَاءَ اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ»

অর্থ: “তোমরা চাওয়াতে হয়না না, যদি না আল্লাহ চান। তিনি সমগ্র বিশ্বের পালনকর্তা।” (সূরা তাওবা 9:51)

«قُل لَا يُصِيبُنَا إِلَّا مَا كَتَبَ اللَّهُ لَنَا»

অর্থ: “কোনো কিছুই আমাদেরকে স্পর্শ করবে না, যদি তা আল্লাহ আমাদের জন্য লিখে না দিয়েছেন।”

(সূরা আত-তগাবুন 64:11)

২. শুধু positive thinking যথেষ্ট, চেষ্টা জরুরি নয়:

LoA কিছু প্রচারক বলে, শুধু পজিটিভ চিন্তাই যথেষ্ট।

ইসলাম বলে প্রচেষ্টা, দোয়া ও তাওয়াক্কুল একসাথে করতে হবে, শুধু পজিটিভ চিন্তাতেই হবেনা।

«توكل على الله ولكن اعقد الأسباب»

অর্থ: “আল্লাহর ওপর ভরসা করো, কিন্তু সকল প্রয়োজনীয় কারণও গ্রহণ করো।” (তিরমিজি 2517)

৩. মানুষ নিজেই তার ভাগ্যের নিয়ন্ত্রক:

LoA বলে, মানুষ নিজেই নিজের ভাগ্যের নিয়ন্ত্রক। এমন বিশ্বাস করা শিরক বা কুফরের পর্যায়। ইসলাম বলে, ভাগ্যের নিয়ন্ত্রক আল্লাহ। একজন মুসলমানকে অবশ্যই তার উদ্দেশ্য সাধনে যথাযোগ্য চেষ্টা করতে হবে (tadbir) এবং ফলাফল تقدير-এর উপর ছেড়ে দিতে হবে। কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পেলে শোকর করবে, না পেলেও শোকর করবে, আল্লাহর সিদ্ধান্তে তাওয়াক্কুল রাখবে। আল্লাহ বলেন-

تَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ وَكَفَى بِاللَّهِ وَكِيلًا

অর্থ: “আল্লাহর ওপর ভরসা করো, এবং আল্লাহই যথেষ্ট প্রতিনিধি।” (সূরা আল-আম্বিয়া 21:102)

একইরকমভাবে, LoA অনুযায়ী, কাজের নেতিবাচক ফলাফলের জন্য ব্যক্তির নেগেটিভ চিন্তাই দায়ী। ইসলামের অবস্থান এখানেও অত্যন্ত ভারসাম্যপূর্ণ। মানুষের কিছু কৃতকর্মের জন্য মানুষ নিজেই দায়ী। আবার কিছু বিষয় মানুষ তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করলেও আল্লাহর ইচ্ছা ও তাক্বদীরের কারণে ফলাফল ভিন্ন হতে পারে। মানুষ তার চেষ্টা ও দুয়া করতে পারে, কিন্তু ফলাফল কী হবে, তার নির্ধারক আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা। তার সিদ্ধান্ত মেনে নেয়াতেই মানুষের কল্যাণ। আল্লাহ বলেন-

وَعَسَى أَنْ تَكْرَهُوا شَيْئًا وَهُوَ خَيْرٌ لَكُمْ وَعَسَى أَنْ تُحِبُّوا شَيْئًا وَهُوَ شَرٌّ لَكُمْ وَاللَّهُ يَعْلَم وَأَنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ

অর্থ: “হয়তো তোমরা কোনো কিছু অপছন্দ করবে, অথচ তা তোমাদের জন্য ভালো হবে; আর হয়তো কিছু ভালোবাসবে, অথচ তা তোমাদের জন্য ক্ষতি করবে। আল্লাহ জানেন, আর তুমি জানো না।”

(সূরা আল-বাকারা 2:216)

৪. অবৈজ্ঞানিক energy/vibration ধারণা

LoA মতে, কল্যাণ বা অকল্যান energy বা vibration এর সাথে রিলেটেড। কিন্তু ইসলাম বলে, সবকিছু আল্লাহর ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল। আল্লাহ বলেন-

مَا يَأْتِيكُمْ مِنْ خَيْرٍ فَمِنَ اللَّهِ

অর্থ: “তোমাদের যেকোনো কল্যাণ আল্লাহর কাছ থেকে আসে।” (সূরা আন-নিসা 4:79)

৫. উদ্দেশ্য সাধনের ৩ ধাপ:

LoA অনুযায়ী উদ্দেশ্য সাধনের ৩ ধাপ:

Ask,

Believe

& Recieve.

সেখানে একজন মুসলিমের ধাপ হবে ভিন্ন-

1. Ask/ Dua: দোয়া করো, আল্লাহর কাছে চাও।

2. Belief/ Yaqeen: ইয়াকীন রাখো যে, আল্লাহ তোমার জন্য উত্তম নির্ধারণ করবেন।

3. Action: চেষ্টা করো ও তাওয়াক্কুল করো কাজের মাধ্যমে প্রমাণ দাও।

4. Tawakkul, Sabr, Shukr (তাওয়াক্কুল ও তাক্বদীরে বিশ্বাস): ফলাফলের জন্য আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করবে। তাক্বদীরের ভালো-মন্দ আল্লাহ থেকে হয়, এই বিশ্বাস রাখবে। কাঙ্ক্ষিত ফলাফলে শোকর করবে, অনাকাঙ্ক্ষিত হলে সবর করবে ও সন্তুষ্ট থাকবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *