My Way is not the Highway…

ইদানিং ফেইসবুকে অনেকেরই লেখার একটা কমন বিষয়বস্তু হচ্ছে, দাওয়াত দেয়ার স্টাইল কেমন হবে তা নিয়ে নানামুখী মত। প্রত্যেকে তার নিজ অভিজ্ঞতা অনুযায়ী উপদেশ দেন, এটা যেমন ঠিক আছে, কিন্তু উনারা কয়েনের বিপরীত পাশটাও যে ভুল না, সেটা বলতে ভুলে যান….

যেমন এই জেনারেশনের একটা কমন ট্রেন্ড হচ্ছে, ইসলামিক কেউ সোজাসাপ্টা কথা বললেই তাকে ‘ফেবু পুলিশ/এমপ্যাথির অভাব’ হেনতেন আখ্যা দিয়ে দেয়া, তাকে নিয়ে প্রকাশ্যে/আড়ালে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করতে থাকা। অথচ এই বিষয়টাই আমরা শিখেছি কুরআনের আয়াত থেকে, ‘অতঃপর তোমরা উপদেশ দাও, কেননা উপদেশ মুমিনদেরই উপকার করে থাকে।’ কিংবা ‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি, তোমাদেরকে বের করা হয়েছে মানুষের জন্য, তোমরা হক্বের আদেশ দিবে আর মন্দকাজে বাধা দিবে।’

হ্যা, বলতে পারেন, কারোর দাওয়াতি এপ্রোচটা আপনার পছন্দ হচ্ছেনা। কিন্তু তার মানে এটাই স্বতঃসিদ্ধ না যে সেই পদ্ধতিটা প্রমাণিত ভুল, যতক্ষণ না তা কুরআন-সুন্নাহর বাইরে চলে যায়। আপনি বলবেন, ইসলাম হিকমাহ শিক্ষা দেয়। আমি বলবো: অবশ্যই ঠিক, কিন্তু হিকমাহর মানে এই না যে সব জায়গায় নরম বনে যেতে হবে, নরমের জায়গায় নরম, গরমের জায়গায় গরম, ‘উপযুক্ত স্থানে উপযুক্ত পদ্ধতি অবলম্বন করার নামই হিকমাহ’। সবার সাথে এক স্টাইল খাটেনা, সব জায়গায় যদি নরম দিয়েই খাটতো তবে বনু করাইযার ঘটনা ইসলামের ইতিহাসে থাকতো না। রাসূলুল্লাহ সা: এর ডান হাত যদি আবু বকর রা: কে চিন্তা করি, তবে উমার রা: তার বাম হাত, এই দুটো মানুষের প্রথমজন নরমের ধারক, দ্বিতীয়জন গরমের বাহক ছিলেন। উমার রা. ইসলামে আসার আগ পর্যন্ত হিকমাহ অবলম্বন করে ইসলাম নিয়ে গোপনেই কাজ চলছিলো, অথচ উমার এসেই নতুন হিকমাহর ঘোষণা দিলেন: ‘এত লুকোছাপা কিসের? ইসলাম যদি সত্য হয়, তবে প্রকাশ্যেই সালাত পড়বো।’ ইসলাম চলে এলো প্রকাশ্যে, তা দেখে ভীরু প্রকৃতির মানুষদের ভাবান্তর হলো- এবার তাহলে ইসলাম গ্রহণ করাই যায়। আবার পরিস্থিতি অনুযায়ী আমরা উনাদের বিপরীত রূপটাও দেখি, আবু বকরের মত এত কোমল মানুষটা যাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন, চিন্তা করা যায়? অথচ উনিতো জোর-জবরদস্তি করে যাকাত আদায় করার মত এত কঠোর না হলেও পারতেন! আবার কঠোরতার প্রতিমূর্তি উমারকেও আমরা দেখি, কীভাবে পিঠে খাবার বয়ে নিয়ে মানুষের দুয়ারে গেছেন, রাত জেগে রাজ্যের মানুষের অভাব অভিযোগের খোজ নিয়েছেন। আল্লাহর রাসূল কি এদের কাউকে ‘ভুল’ বলে অভিহিত করেছিলেন? এমনকি একবার যুদ্ধের পর রাসূল সা. এর দেয়া একটা কোমল সিদ্ধান্তের বিপরীতে উমারের কঠোর সিদ্ধান্তটাকেই আল্লাহ স্বয়ং কুরআনে হক্ব বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন।

অথচ দাওয়াতদানে অকপট/সোজাসাপ্টা কিংবা একটু কঠোর ধাচের হলেই আমরা তাকে ভুল প্রমাণ করতে লেগে যাই। আমি আমার নিজের জীবনেই এই বৈপরিত্যের একটা বাস্তব উদাহরণ দিই:

আমার মা আর আমি এই দিকটায় মা-মেয়ে হয়েও পুরো বিপরীত, আম্মু খুব ধুমধাম দ্বীনের দাওয়াত দিয়ে দিতে পারেন, মুখের উপর ভুল সংশোধন করে দিতে পারেন। অনলাইনে আমি বকবক বেশি করলেও অফলাইনে পারিনা, কাউকে একটা দ্বীনের কথা বলার আগে সাতবার ভাবি-

কথাটা এই মুহুর্তে তাকে বলা উচিৎ হবে কিনা,

তার গ্রহণ করার মত মাইন্ড সেটাপ আছে কিনা,

আমার উপর অতখানি নির্ভরতা তৈরি হয়েছে কিনা,

আমার কোন কথায় সে দ্বীনকে কঠিন মনে করে বসবে কিনা,

জোর প্রয়োগ করলে উলটো দ্বীন থেকে দূরে সরে যাবে কিনা…..

এই সাত-পাচ-তিন-দুই ভাবতে ভাবতে আর এপ্রোচটাই করা হয়না। আখলাক দিয়ে দ্বীনের সৌন্দর্যটা বোঝানোর চেষ্টা করি, দাওয়াত দেয়ার প্রেক্ষাপট তৈরি করি, হাদিয়া দিয়ে খুশি করি, শেষপর্যন্ত কাউকে দাওয়াত দিতে পারি, আবার অনেক ক্ষেত্রে দাওয়াত দেয়ার আগেই শিকার হাতছাড়া হয়ে যায়, পরে আফসোস হয়: ইস, সেদিন বলে দিলেই ভালো হতো!

বিপরীতে আম্মু যাদেরকে দাওয়াত দেন, আম্মুর এপ্রোচে আমি নিজেই মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে যাই: একদিনের পরিচয়েই এভাবে দাওয়াত দিয়ে বসলো? বিরক্ত হয়ে যায় যদি!

এবার আমাদের দুজনের দাওয়াতের ফলাফল পর্যালোচনা করে দেখি। অন্তরের নিয়াত অনুযায়ী হয়তো দুজনেই সাওয়াব পাবো ইনশাআল্লাহ। কিন্তু হিদায়াতের উপর উঠিয়ে দিতে পারলো কে, সেই হিসেবে আমি ব্যর্থ অনেকটাই। সেখানে আম্মুর সফলতা অনেক বেশি।

এর আগে এক নতুন বিল্ডিংয়ে উঠেছিলো আম্মুরা। ঢাকা শহরে এপার্টমেন্টের বাসিন্দারা ইউজুয়ালি কেউ কারো সাথে ধাক্কা না লাগলে কথা বলেনা, সেখানে আম্মা রুটিন করে এক এক ফ্ল্যাটে আন্টিদের খোজ নিতে যেতো। নতুন বাড়িতে উঠে দুই মাসের মাথায় ছয় তলা বিল্ডিং পুরোটা দাওয়াত দেয়া শেষ, তালীমের দিন আম্মুর সাথে এক দল তালীমে যায় বিল্ডিং থেকেই, আর ৮০% আন্টি আম্মুর তাজউয়ীদ ক্লাসে নিয়মিত কুরআন পড়ছে। আমি শুনে তাজ্জব বনে যাই, কেম্নে কী? আমিতো এক বছরেও এতখানি রীচ করতে পারতাম না। সেই বাড়ি ছেড়ে আসার সময় আন্টিরা আম্মুকে জড়িয়ে ধরে কি কান্নাকাটি!!

নতুন বিল্ডিংয়ে উঠেছি, এখানেও একই কাহিনী। কয়েকটা আন্টিতো এমন হয়েছিলো, আম্মুকে দেখলেও বিরক্ত হতো। কিন্তু উনি হাল ছাড়ার পাত্র নন, দুদিন পর হাদিয়া পাঠাবেন, তিনদিন পর খোজ নিতে যাবেন, আবার দ্বীনের দাওয়াত দিবেন। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এখন সেই আন্টিরাই এতখানি হিদায়াত পেয়ে গেছেন, আলহামদুলিল্লাহ, নিজেরা যেচে এসে এসে আম্মুর কাছে বিভিন্ন বিষয়ে জানতে চান, আম্মুকে উস্তাযা মানেন। আমরা এই বাসা ছেড়ে যাবো শুনলে উনারা কান্নাকাটি শুরু করে দেন। দেখলে বোঝার উপায় নেই, শত বিরক্তি সত্ত্বেও এদের পিছনে আম্মু কেমন জোকের মত লেগেছিলো এতটা দিন। আমি হলে তো কবেই থেমে যেতাম: ‘থাক, বিরক্ত হচ্ছে। এভাবে মনের বিরুদ্ধে জোর করা ঠিক না, আল্লাহ চাইলে একসময় ঠিকই সত্যটা চিনিয়ে দেবেন’, এমনটা ভেবে….

আম্মু সকালবেলা হাটতে বের হন, এলাকার হাটনেওয়ালা আন্টিদের গল্পের হাট বসে ঐ প্রত্যুষে, যার বেশিরভাগই গীবত। এই হাটতে হাটতে গল্প করতে করতেই দাওয়াত দিয়ে ফেলেছেন অনেককে, অল্প সময়ের ব্যবধানে আম্মুর হাটার সাথীদের একটা ব্যাচ পুরো এখন আম্মুর কাছে সহীহ কুরআন শিখছে, মাশাআল্লাহ! আমি রীতিমতো অবাক হতে হতেও অবাক! এত দ্রুত কীভাবে সম্ভব??

হোস্টেলে আমার এক বান্ধবী ছিলো, বান্ধবীমহলে গল্পের সময় দ্বীনি ফ্রেন্ডরা গীবত তেমন না করলেও নন প্র‍্যাক্টিসিংরা তো দেদারসে গীবত করে। তো মনে মনে ঘৃণা করলেও আমি সবসময় মুখের উপর বলতে পারতাম না, কষ্ট পেয়ে যায় কিনা। কিন্তু আমার ঐ ফ্রেন্ড বলে ফেলতো: তুই কিন্তু গীবত করছিস! ব্যস, থেমে যেতো আলোচনা।

দেখুন, আমি কিন্তু এখনো আম্মুর কিংবা ঐ বান্ধবীর এপ্রোচটা নিজে গ্রহণ করতে পারিনি। তারপরেও আমি এটা অকপটে স্বীকার করি: আম্মু আমার চেয়ে অনেক বড় মাপের দা’ঈ, তার দাওয়ায় বারাকাহ আছে, আমার কাছে সিস্টেমটা একটু বিরক্তিকর মনে হলেও আল্লাহর কাছে অবশ্যই পছন্দের, তা নাহলে এত এত মানুষ তার ডাকে সাড়া দিয়ে কিভাবে প্র‍্যাক্টিসিং জীবনে চলে আসছে? একজন মানুষকে হেদায়াতের পথে তুলে দেয়ার চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে? অনলাইনে হয়তো আমার লেখায় অল্পকিছু মানুষের জীবনে পরিবর্তন এসেছে(আলহামদুলিল্লাহ), কিন্তু অফলাইনে তো আমি তেমন কিছুই করতে পারিনি! একটা মানুষকে দাওয়াত দেয়া ঠিক হবে কিনা আমি এটা ভাবতে ভাবতেই আম্মার দাওয়াতে তারা দ্বীনের ছায়াতলে ভীড়ে যায়….

তাহলে আমি কি করে বলতে পারি, আমার হিকমাহটাই একমাত্র ঠিক? হতে পারে, আমার ওয়েটাও একটা ওয়ে, কিন্তু My way is not always the highway, এটা মানতে হবে। আমার অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের ভিত্তিতে আমি দাওয়াত দেবো, কিন্তু অন্য কেউ যদি তার অভিজ্ঞতা ও সোসাইটি অনুযায়ী অন্যভাবে দেন সেটাও ঠিক, যতক্ষণ না তা ইসলামের মূলনীতির সাথে সাংঘর্ষিক হয়।(তবে আপনি বেপর্দা মহিলা দিয়ে গাইরে মাহরামের সাথে অভিনয় করিয়ে ব্যাকগ্রাউন্ডে হাই মিউজিক বাজিয়ে যদি বলেন, এটাই ইসলাম, আমি মেনে নেবোনা। আপনি ভুল, এটা আপনার মুখের উপরেই বলে দিতে আমি বাধ্য, কারণ নুসূস আপনার সরাসরি বিপক্ষে, কোন সন্দেহ নেই।)

দ্বীনের দাওয়াত কেউ পরোক্ষভাবে পেয়ে দ্বীনে আসে, কেউ সরাসরি পেয়েও আসে। ইসলাম আখলাকের মাধ্যমে যেমন ছড়িয়েছে, যুদ্ধের ময়দানে তরবারির ঝনঝনানিতেও ছড়িয়েছে, ইতিহাস সাক্ষী। এই যেমন, আমি মিউজিকের পাগল ছিলাম, মিউজিক ছাড়তে আমার অনেক চড়াই উৎরাই পার হতে হয়েছে, একদিন পারিনি, ধীরে ধীরে একটু একটু করে ছেড়েছি। আবার বিপরীতে আবু ফাতিমাহ ‘মিউজিক হারাম’ এইটুকু জেনেই ছেড়ে দিতে পেরেছে, তার হয়তো মিউজিক আসক্তি ঐ পরিমাণে ছিলোনা৷ এখন আপনি কি বলবেন, দাওয়াত দিতে গিয়ে ‘মিউজিক হারাম’, এটা বলা উচিৎ না? হতে পারে, এটা মন থেকে মেনে নিতে কারও একদিন লাগবে, কারও একবছর লাগবে, কারও দশ বছরও লেগে যেতে পারে। কিন্তু ‘মিউজিক হারাম’ এই হক কথাটা যার মুখে প্রথমবার শুনেই একজন মিউজিক ছেড়ে দিলো, তার জন্য ঐ কথাটুকুই হিদায়াতের একমাত্র উৎস ছিলো। আর যে দশ বছর পর ছাড়লো, তার জন্য ঐ কথাটি ছিলো ছিলো টাইট্রেশনের প্রথম ফোটা, এরপর যে যতবার মিউজিক শুনেছে, একবার হলেও বিবেক তাকে বলেছে: তুমি হারাম কাজ করছো। আপনি হয়তো শেষ ফোটা দেখেছেন, কিন্তু আল্লাহর হিসেবে ঐ প্রথম ফোটাটুকুও আছে। আসলে কাউকে হিদায়াত পাইয়ে দেয়া কিন্তু আমাদের দায়িত্ব না, বরং আল্লাহর সত্য বাণী পৌঁছে দেয়াটাই আমাদের দায়িত্ব, তার দ্বারা যাকে যখন ইচ্ছা আল্লাহই হিদায়াত দিয়ে দিবেন, আর যে হিদায়াতের যোগ্য না, তাকে যত মধুর ভাষায়ই বলা হোক না কেন, কস্মিনকালেও সে হিদায়াত পাবেনা। আমরা আমাদের দাওয়াতটা পৌছে দিতে পেরেছি কিনা, এটাই চিন্তার বিষয়, হেদায়েত দেয়ার মালিক আল্লাহ।

হিকমাহর সংজ্ঞা একেকজনের কাছে একেকরকম, মানুষের জেনেটিক কোডই যে একেকরকম! এজন্য দাওয়াতের সঠিক পন্থা কী, তাকে কোন নির্দিষ্ট ছকে ফেলা যায়না, কেউ আকার-ইঙ্গিতে দ্বীন পায়, কেউ সরাসরি কথাতেও দ্বীন পায়। যতক্ষণ না দাওয়াতের পদ্ধতি নববী পদ্ধতির সাথে সাংঘর্ষিক হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত সবাই ঠিক। আমাদের পরিবার থেকে, সমাজ থেকে, অনলাইন থেকে “সৎ কাজে আদেশ, অসৎ কাজে নিষেধ, ভুল কাজে সংশোধনী” দেয়ার মত মানুষগুলো যদি সব মুখচোরা হয়ে ডুব দিতো, তবে আমাদের অনেক নন প্র‍্যাক্টিসিং ভাইবোনের কানে দ্বীনের দাওয়াতটুকুও পৌছতো না, প্র‍্যাক্টিসিংরাও ধীরে ধীরে তাগুতকেই হক মনে করে বসতো, ভুলের উপর বাহবা পেয়ে ভুলটাকে সঠিক মনে করে আকড়ে ধরতো, গাফিলীনিদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেতাম আমি আপনি সবাই। কেউ না কেউ চোখে আঙ্গুল দিয়ে ভুলটা ধরিয়ে দেয় বলেই আমরা নিজের ভুলটা নিয়ে নতুন করে ভাবতে পারি।

আল্লাহ আমাদের হিফাজত করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *